প্রকাশকাল: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১১
বিশ্ব ধরিত্রী দিবস ২০১১
ভুমি ও পানিসম্পদ ব্যবহারে চাই স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা
চাই টেকসই জীববৈচিত্র্য, রক্ষা কর জীবন ও জীবিকা
১৯৬৯ সালে স্যান ফ্রান্সিসকোতে অনুষ্ঠিত UNESCO সম্মেলনে প্রথম বিশ্ব ধরিত্রী দিবসের ধারণা উত্থাপিত হয় এবং সবাইকে পৃথিবীর প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষায় সচেতনতা ও মূল্যবোধ গড়ে তোলার ডাক দেয়া হয় । বিশ্ব ধরিত্রী দিবস জীববৈচিত্র্য রক্ষাসহ সকল মানুষের জীবনমানের টেকসই উন্নয়ন এবং বিশ্বে সকল প্রকার ক্ষমতার অপব্যবহার রোধে নাগরিকদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের সুযোগ তৈরি করেছে।
বনভূমির নির্বিচার নিধন, অনিয়ন্ত্রিত পরিবেশ দূষণকারী শিল্প প্রতিষ্ঠা এবং এগুলো রোধে বিশ্বব্যাপী কার্যকর পদক্ষেপের অভাবে বিশ্ব ক্রমান্বয়ে উষ্ণ হতে শুরু করে এবং বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এবং জলবায়ুর পরিবর্তন পৃথিবীর অস্তিত্বের জন্য অন্যতম হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। বিজ্ঞানীদের বারবার সতকর্তা সত্ত্বেও বিশ্ব নেতৃবৃন্দ এ বিষয়ে কর্ণপাত করছিলেন না। অবশেষে বিজ্ঞানীদের বিরতিহীন চাপের ফলে ১৯৮৮ সালে Inter Governmental Panel For Climate Change (IPCC) এর জন্ম হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিওতে অনুষ্ঠিত হয় বিশ্ব ধরিত্রী সম্মেলন এবং জন্ম হয় United Nations Framework Convention on Climate Change (UNFCCC) এর।
ধরিত্রীর অস্তিত্ব্ব, জলবায়ু পরিবর্তন এবং বাংলাদেশ: বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম প্রভাবগুলো হলো সাগর এবং স্থলভাগে বাতাসের ক্রমবর্ধমান গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি, মেরু এবং পাহাড় অঞ্চলে দ্রুত বরফ গলা, সাগরের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি, কৃষি জমি ও সাধু পানির উৎস সমূহতে লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশ এবং ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুূর্যোগ। এ পরিবর্তনের জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে মনুষ্যসৃষ্ট কারণগুলো দায়ী। আর বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে সবচেয়ে বিপদগ্রস্ত' দেশগুলোর শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের এ প্রভাব দৃশ্যমান হওয়ার পাশাপাশি নিম্ন আয় এবং জলবায়ু উদ্বাস্থদের প্রাপ্য সরকারি খাস জমি এবং জলাধার এক শ্রেণীর রাজনীতিবিদ, আমলা, ভূমি ব্যবসায়ীরা দখলের মহোৎসবে নেমেছে। জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, খরার মতো প্রাকৃতিক দুূর্যোগের প্রকোপ ভয়াবহভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে উপকূল অঞ্চলের মানুষ নিজ বাস্থভিটা থেকে উচ্ছেদিত হচ্ছে এবং এ অঞ্চলের খাবার পানির উৎসসমূহে লবণাক্ততা বেড়ে সেগুলো ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে যাচ্ছে।
এই প্রেক্ষাপটে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) জলবায়ু খাতের সাথে সমপৃক্ত সকল স্টেকহোল্ডারদের অংশগ্রহণে বিশ্ব ধরিত্রী দিবস ২০১১ পালন করছে। আমাদের দাবি হলো ‘‘ভুমি ও পানিসম্পদ ব্যবহারে চাই স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা, চাই টেকসই জীববৈচিত্র্য, রক্ষা কর জীবন ও জীবিকা”।
ভূমি দখল: বাংলাদেশের কৃষি নির্ভর অর্থনীতি অনেকাংশে ভূমি ব্যবহার এবং ভূমি ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল। অবৈধ ভূমি খাস জমি দখল যেমন কক্স্রবাজার সমুদ্র সৈকতের ভূুমি অবৈধ ভাবে দখল করে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ; ঢাকা ও তার আশেপাশের অঞ্চলসহ সারা দেশে অবৈধভাবে ভূমি ও নদী দখলের মহোৎসব চলছে। বিভিন্ন জলামহল ও নদী থেকে অবৈধ ভাবে বালু উত্তোলন ব্যাপক ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
খাস জমির বিতরণ এবং বঞ্চিত দরিদ্র জনগোষ্ঠী: ভূমি প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনায় বিদ্যমান দুর্নীতি ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং জনগণ মৈৗলিক অধিকার ও সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ, রাজনীতিবিদ ও সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে একটি নেতিবাচক সংযোগ বা সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে, যারা বিভিন্ন সরকারি খাসজমি নামে-বেনামে দখল করে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছেন এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠী তাদের অধিকার হতে বঞ্চিত হচ্ছেন। উল্লেখ্য, টিআইবি পরিচালিত ২০১০ সালে দুর্নীতি সংক্রান্ত জাতীয় খানা জরিপে দেখা যায় যে ভূমি প্রশাসন প্রধান ৫ টি দুনীতিগ্রস্ত খাতের মধ্যে অন্যতম।
বনভূমি উজার: সহস্র্রাব্দের লক্ষমাত্রা অনুযায়ী ২০১৫ সাল নাগাদ বাংলাদেশে বনভূ'মির হার ২০% এ উন্নীত করার কথা বলা হলেও এ হার এখনো নিম্ন্ন। প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে প্রতিরোধ করতে সক্ষম পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবনের ভূুমি দখল ও নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন আর অপরিকল্পিতভাবে বনভূুমি ধ্বংস ও দখল এই প্রাকৃতিক দূর্যোগের মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে। শুধু তাই নয়, পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের সাবধান বাণী উপেক্ষা করে সুন্দরবনের কাছে কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগের মাধ্যমে সুন্দরবনের স্থায়ী ক্ষতি সাধনের পথ উন্মোচিত হচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে, উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ ক্রমান্বয়ে সহায় সম্পদ হারিয়ে নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষের জীবন এবং জীবিকার ক্ষতির ঝুঁকি বেড়েই চলছে। একই সাথে প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও জীববৈচিত্র্য নষ্ট হচ্ছে প্রতিনিয়ত এবং অনেক বিরল প্রজাতির অস্তিত্ব পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাচ্ছে।
অবৈধভাবে জলাশয় ভরাট ও দখল: নদ-নদীর দেশ বাংলাদেশের নদীতে এখন আর পানি নেই, উজানের দেশসমূহ কর্তৃক পানি প্রত্যাহারের সাথে সাথে বিভিন্ন নদী, যেমন বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষা, মেঘনা ও বিভিন্ন খাল-বিল অবৈধভাবে দখল করে ভরাট করার ফলে পানির উৎস যেমন হারিয়ে যাচ্ছে, তেমনি জীববৈচিত্র্য বিশেষ করে মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র এবং অন্যান্য অনুজীবসমূহ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
পানির উৎসমূহে বর্জ্য নিষ্কাশন এবং দূষণ: জাতীয় পানি নীতি অনুযায়ী নদীমাতৃক বাংলাদেশের জীবনধারা পানির ভিত্তিতে গঠিত। পরিমাণ ও গুণগত মানের পানির সহজপ্রাপ্যতাকে মৌলিক নাগরিক অধিকার হিসেবে বলা হলেও সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার কাঙ্খিত পর্যায় থেকে বাংলাদেশ এখনও অনেক দূরে অবস্থান করছে। বিভিন্ন শিল্প মালিক কর্তৃক বিভিন্ন নদী এবং জলাধারে আইন অমান্য করে এবং অবাধে রাসায়নিক বর্জ্য নিক্ষেপের ফলে সার্বিকভাবে খাদ্যশষ্যে বিষক্রিয়া এবং জনস্বাস্থ্য প্রবলভাবে হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে।
স্থানীয় জনগণের সামষ্টিক মালিকানার ভিত্তিতে ঐতিহাসিকভাবে পরিচালিত পানিসম্পদ ক্ষেত্রসমূহ রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম এবং দুর্নীতির মাধ্যমে ইজারা প্রদানের উৎসব চলছে। পানি ও ভূমি সম্পদের সঠিক ব্যবহার ও রক্ষার জন্য নীতিমালা ও আইন আছে কিন' তার যথাযথ বাস্তবায়ন নেই। ফলশ্রুতিতে ভয়াবহ সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত নেতিবাচক প্রভাব যেমন পরিবেশ দূষণ, স্বাস্থ্যহানি, কর্ম ও বাসস্থান থেকে উচ্ছেদ ইত্যাদির শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। ভূমি ও পানিসম্পদ রক্ষায় সচ্ছতা ও জবাবদিহিতা না থাকায় মুষ্টিমেয় কিছু ব্যক্তি/বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কাছে সকল ভূমি ও সম্পদ পুঞ্জীভুত হচ্ছে। ফলে বিভিন্ন অঞ্চলের পেশাজীবি মানুষ তাদের ঐতিহ্যগত পেশা ত্যাগ করে কাজের আশায় ঢাকা সহ প্রধান শহরগুলোতে এসে ভাসমান ও পরিবেশ/জলবায়ু উদ্বাস্থশ্রেণীতে পরিণত হচ্ছে। এ সকল সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি-
ভূমি এবং পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় সংশ্লিষ্ট সকলের জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে;
ভূমি ও পানি সম্পদের উপর সকল নাগরিকের অধিকার ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রকল্প বাস্তবায়নে নাগরিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে;
পানি সম্পদকে উন্নয়ন ও জনগনের জীবনমান পরিবর্তনের লক্ষ্যে কার্যকর ভাবে ব্যবহারের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে;
সকল আন্তর্জাতিক চুক্তির ক্ষেত্রে সুন্দরবনসহ সকল প্রাকৃতিক সম্পদে টেকসই অস্তিত্বকে প্রাধান্য দিতে হবে:
ভূমি ও পানি সম্পদে দখলদারিত্ব বন্ধ করতে হবে এবং ভূমি ও পানি সম্পদ খাতে বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতি বিশেষ করে দায়িত্বে অবহেলা, ক্ষমতার অপব্যবহার, ঘুষ বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে;
পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন সহ অন্যান্য বনভূমি দখল ও নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন বন্ধ করতে হবে;
অবৈধ ভূমি দখল যেমন কক্স্রবাজার সমুদ্র সৈকতের ভূমি অবৈধ ভাবে দখল ও অবৈধ স্থাপনা নির্মান বন্ধ করতে হবে;
সকল নাগরিকের জন্য পরিমাণ ও গুনগত মানসম্পন্ন পানির সহজপ্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে;
বিষাক্ত পদার্থ সরাসরি জলাধারে নির্গমনবন্ধ করতে হবে;
শিল্পবর্জ্য নির্গমনের বিধিমালা প্রয়োগ এবং পানি দূষনকারীদের কাছে থেকে উল্লেখযোগ্য হারে জরিমানা আদায় করতে হবে;
বিভিন্ন জলামহল ও নদী থেকে অবৈধ ভাবে বালু উত্তোলন বন্ধ করতে হবে;
দ্রুত Detailed Area Plan (DAP) বাস্তবায়ন করতে হবে;
ভূমি ও পানি সম্পদ রক্ষায় কার্যকর আইন প্রয়োগ করতে হবে এবং জীব ও প্রাণী বৈচিত্র্য রক্ষা করতে হবে।
বিশ্ব ধরিত্রী দিবস জীববৈচিত্র্য রক্ষাসহ সকল মানুষের জীবনমানের টেকসই উন্নয়ন এবং সকল প্রকার ক্ষমতার অপব্যবহার রোধে নাগরিকদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের সুযোগ তৈরি করেছে। আমরা বাংলাদেশে ভূমি ও পানি সম্পদ ব্যাবস্থাপনায় আইনের সঠিক প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন চাই। আমরা বিশ্বাস করি সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জীববৈচিত্র্য রক্ষা পাবে, জীবন ও জীবিকা সমৃদ্ধ হবে।
জলবায়ু তহবিলের ব্যবস্থাপনায় সততা, স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করুন