টিআইবি’র গোলটেবিল বৈঠক
এলজিইডিতে দুর্নীতি প্রতিরোধ, সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও
রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ হ্রাসের উপর গুরুত্বারোপ
ঢাকা, ২১ জুলাই ২০১৩:আজ এক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা গ্রামীণ অবকাঠামোর উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা পালনের স্বার্থে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) দুর্নীতি প্রতিরোধ, সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও প্রভাব হ্রাসের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন।
সিরডাপ মিলনায়তনে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) আয়োজিত ‘স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর: সুশাসনের সমস্যা ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে জানানো হয় যে অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক নিয়ামকের প্রভাবের কারণে এলজিইডি প্রত্যাশিত লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হচ্ছে না এবং কোন কোন ক্ষেত্রে সংস্থাটিতে দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়েছে।
টিআইবি’র ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য জনাব এম. হাফিজউদ্দিন খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত গোলটেবিল আলোচনায় মুখ্য আলোচক ছিলেন স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক সালাহউদ্দিন এম. আমিনুজ্জামান। অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন এলজিইডি’র অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী জনাব আবুল কালাম আজাদ, টিআইবি‘র উপ-নির্বাহী পরিচালক ড. সুমাইয়া খায়ের, এলজিইডি’র কর্মকর্তাবৃন্দ এবং গণমাধ্যম প্রতিনিধিবৃন্দ। অনুষ্ঠানে এলজিইডি সংক্রান্ত প্রতিবেদনের সারাংশ তুলে ধরেন টিআইবি’র গবেষণা ও পলিসি বিভাগের সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার শাহজাদা এম আকরাম ও ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার নাহিদ শারমিন এবং সঞ্চালক ছিলেন টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।
ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, “এলজিইডিকে অবশ্যই তার কাজের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা আনয়নের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে।” তিনি এলজিইডিকে আরো গতিশীল করার স্বার্থে আমলাতান্ত্রিক দৌরাত্ব্য প্রতিরোধের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
অধ্যাপক সালাহউদ্দিন এম. আমিনুজ্জামান বলেন, “সুনির্দিষ্ট আইন ও মিশন ব্যতিরেকেই এলজিইডি কাজ করায় প্রতিষ্ঠানটি বহুবিদ কাজে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছে।” তিনি সংবিধানের আলোকে সংস্থাটির জন্য কার্যকর আইন প্রণয়নের ওপর জোর দেন।
দীর্ঘ তিন বছর অনুসন্ধানমূলক গবেষণার মাধ্যমে প্রণীত এই প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশের গ্রামীণ অবকাঠামো বাস্তবায়নকারী দেশের সর্ববৃহৎ সংস্থা এলজিইডি সূচনা লগ্ন থেকে উল্লেখযোগ্য নানা ইতিবাচক অর্জন করলেও দলীয় রাজনৈতিক প্রভাব, মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ, প্রকল্পের নিরীক্ষা ও মূল্যায়নে সিজিএ, সিএজি এবং আইএমইডি’র সীমাবদ্ধতা, অস্থিতিশীল বাজার ও প্রকল্পের দীর্ঘসূত্রিতা প্রভৃতি কারণে প্রত্যাশিত সাফল্য অর্জন করতে পারছে না। অন্যদিকে জনবল ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা, তদারকির অভাব, নীতিমালা বাস্তবায়নের অভাবে অনেক ক্ষেত্রে দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ ঘটেছে। বিশেষত: এলজিইডি’র প্রধান প্রকৌশলীর একচ্ছত্র ক্ষমতা প্রয়োগ ও রাজনৈতিক প্রভাবের ফলে পদায়ন, বদলী, পদোন্নতির ক্ষেত্রে ব্যাপক অনিয়মের ঘটনা সংঘটিত হয়েছে।
গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী স্বেচ্ছাধীনভাবে গাড়ীসহ অফিসের লজিস্টিকের ব্যবহার বিশেষতঃ বেআইনীভাবে ব্যক্তিগতকাজে গাড়ী ব্যবহার এবং ব্যবহার সংশ্লিষ্ঠ সকল খরচ যেমন- তেল, ড্রাইভারের ওভারটাইম এলজিইডি থেকে পরিশোধ, সম্ভাব্যতা যাচাই ব্যতিরেকে প্রকল্প প্রণয়ন, ব্যয় প্রস্তাবনা প্রাক্কলনে অনিয়ম, কার্যাদেশ প্রদানে রাজনৈতিক প্রভাব, দরপত্র নিয়ন্ত্রণ,দরপত্র পেশের পর শিডিউল পরিবর্তনসহ প্রকৌশলী ও ঠিকাদারদের সমঝোতার মাধ্যমে বিভিন্ন দুর্নীতি, বিল উত্তোলনে দুর্নীতিসহ এলজিইডিতে নানা ধরণের দুর্নীতি ও অনিয়ম পরিলক্ষিত হয়।
প্রতিবেদনে জানানো হয় প্রত্যেক ঠিকাদারকে এলজিইডি’র বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের প্রতিটি বিল থেকে ৮.৫% থেকে ১০.৫% কমিশন দিতে বাধ্য করা হয়। ঠিকাদারদের প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী এভাবে কমিশন বাবদ কোটি কোটি টাকা ঠিকাদারদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়া হয়। অন্যদিকে ঠিকাদাররা নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহার করার ফলে অনেক প্রকল্পই যথাযথভাবে টেকসই হতে পারে না। স্থানীয় পর্যায়ে সংসদ সদস্য, মন্ত্রী এবং তাদের ঘনিষ্ঠজনেরা দরপত্র ও কার্যাদেশ নিয়ন্ত্রণ করেন এবং রাজনীতিবিদদের ইচ্ছা অনুযায়ী প্রকৌশলীদের কাজ করতে হয়। এর অন্যথা হলে শারীরিক লাঞ্ছনারও সম্মুখীন হতে হয়। এছাড়া একটি স্কিম যেভাবে পরিকল্পনা করা হয় বাস্তবায়নের সময় সেই পরিকল্পনা অনুসৃত হয় না। উদাহরণ হিসেবে গবেষণার পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী একটি প্রকল্প এলাকায় ৮টি ইউপি কমপ্লেক্সের বিপরীতে দুইটি এবং ৪৫টি গ্রোথ সেন্টারের বিপরীতে ৮টি নির্মিত না হওয়ায় সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয় কয়েক কোটি টাকার। আবার দু’টি উপজেলায় রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে অপ্রয়োজনীয়ভাবে নির্মাণ করা হয় কয়েক’শ ছোট বড় ব্রিজ। সার্বিকভাবে প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে উন্নয়ন সহযোগী, রাজনীতিক ও বাস্তবায়নকারী সংস্থার অনাকাঙ্খিত প্রভাবের কারণে সাধারণ গ্রামীণ জনগণ চাহিদা অনুযায়ী উন্নয়নের সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
প্রতিবেদনে নীতি নির্ধারণ, প্রাতিষ্ঠানিক, প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, তথ্য প্রকাশ ও জবাবদিহিতার ক্ষেত্রে ১৫টি সুপারিশ উপস্থাপন করে বলা হয় সংশ্লিষ্ঠ আইন সংশোধন করে তৃণমূল পর্যায়ের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের বাস্তবায়নে সংসদ সদস্যদের সম্পৃক্ততা বন্ধ করতে হবে। এছাড়া ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রণোদনা যেমন- এলজিইডি কর্মকর্তাদের ক্যাডার সার্ভিসে অন্তর্ভুক্তকরণ, পদোন্নতি ও পদায়নের ক্ষেত্রে অনিয়ম দূরীকরণ, দুর্নীতির সাথে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারিদের বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ, অভ্যন্তরীণ এবং আইএমইডি কর্তৃক পর্যাপ্ত ও কার্যকর তদারকি ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ, সর্বোপরি প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এলজিইডিকে দলীয় রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে হবে।