বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক দুর্নীতি বিরোধী দিবস উদযাপন; দুর্নীতি প্রতিরোধে ডেটা সাংবাদিকতার চর্চা বৃদ্ধি এবং তথ্যের উন্মুক্ততা নিশ্চিতের আহ্বান টিআইবির

সংবাদ বিজ্ঞপ্তি

আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস ২০২২

ঢাকা, ৯ ডিসেম্বর ২০২২: দুর্নীতিবিরোধী বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে প্রতি বছরের ন্যায় এবারও জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস পালন করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবসে জাতিসংঘের এবারের প্রতিপাদ্য ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে বৈশ্বিক ঐক্য’ (Uniting the World against Corruption)- -এর সাথে মিল রেখে এ বছর টিআইবি ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে একসাথে’ এই প্রতিপাদ্য নিয়ে দিবসটি উদ্যাপন করেছে। তরুণদের মধ্যে দুর্নীতিবিরোধী চেতনা ছড়িয়ে দিতে এ উপলক্ষে জাতীয় পর্যায়ে দুর্নীতিবিরোধী অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা পুরস্কার ২০২২ এবং দুর্নীতিবিরোধী কার্টুন প্রতিযোগিতা ও প্রদর্শনীর আয়োজন করে টিআইবি। এ ছাড়া দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আয়োজিত মানববন্ধনে ঢাকাস্থ টিআইবি অফিস ও ঢাকা ইয়েস গ্রুপ অংশগ্রহণ করে। পাশাপাশি, স্থানীয় সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে সাথে নিয়ে সারাদেশের ৪৫টি অঞ্চলের সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক), অ্যাকটিভ সিটিজেনস গ্রুপ (এসিজি) ও ইয়ুথ এনগেজমেন্ট অ্যান্ড সাপোর্ট (ইয়েস) গ্রুপের সদস্যবৃন্দ র‌্যালি, আলোচনা সভা ও তথ্যমেলার আয়োজন করে।

জাতীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে আজ সকাল ১০:০০টায় টিআইবির ধানমন্ডিস্থ কার্যালয়ে ‘দুর্নীতি প্রতিরোধে ডেটা সাংবাদিকতা: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ ’ শীর্ষক আলোচনা ও দুর্নীতিবিরোধী অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা পুরস্কার ২০২২ ঘোষণা করা হয়। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনা করেন টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের কোঅর্ডিনেটর মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক শেখ মনজুর-ই-আলম। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ও উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের।

ডেটা সাংবাদিকতার গুরুত্ব তুলে ধরে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “বিশ্বব্যাপী দুর্নীতি উন্মোচনে ডেটা সাংবাদিকতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। প্যানডোরা পেপারস, প্যারাডাইস পেপারস এর মতো অনুসন্ধান তাই প্রমাণ করে। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার বিশ্বাসযোগ্যতা বৃদ্ধি করছে ডেটা সাংবাদিকতা। ডিজিটাল বিশ্বে ডেটা সাংবাদিকতার আরো সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। তবে, ডেটা সাংবাদিকতা নিয়ে বাংলাদেশে খুবই অল্প কাজ হয়েছে এবং এটি বাংলাদেশে এখনও পুরোপুরি বিকাশের সুযোগ পায়নি।”

তিনি বাংলাদেশে গণমাধ্যমের চ্যালেঞ্জ প্রসঙ্গে বলেন, “যখন গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব হয় তখন দুই ধরনের প্রভাব পড়েÑ একদিকে গণমাধ্যম সেল্ফ সেন্সরশিপের চর্চা করতে বাধ্য হয় এবং গণমাধ্যমের একাংশ কোঅপটেট হওয়ার কারণে গণমাধ্যমের অভ্যন্তরীন বিভাজন বৃদ্ধি পায়। দুটির সংমিশ্রনে গণমাধ্যমের ঝুঁকি আরো বেশি বাড়ছে।” তিনি আরো বলেন, “দীর্ঘদিন ধরে বাকস্বাধীনতা, তথ্য ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে হুমকির পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে এবং ‘shoot the messenger’ (বার্তাবাহককে স্তব্ধ করো) নামক সংস্কৃতির চর্চার বিকাশ ঘটেছে । প্রকাশিত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার পরিবর্তে যে তথ্য প্রকাশ করছে তাকে হয়রানি করার প্রবণতা বাড়ছে। নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমকে জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার সহায়ক হিসেবে বিবেচনার পরিবর্তে হুমকির উৎস হিসেবে দেখা হচ্ছে। এটি গণতন্ত্রের জন্য অশনি সংকেত এবং মানবাধিকার অর্জনে বড় অন্তরায়।

ঢাকা ট্রিবিউনের নির্বাহী সম্পাদক রিয়াজ আহমেদ বলেন, “বাংলাদেশে সাংবাদিকতাকে উৎসাহ প্রদানে ঘাটতি রয়েছে বরং এর চেয়ে হুমকির প্রবণতা বেশি। ডিজিটাল সিকিরিটি আইন ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো ঘোষণার মাধ্যমে তথ্য গ্রহণে বাধা সৃষ্টির চেষ্টা দেখা যায়। কিন্তু এই প্রতিবন্ধকতার মাঝেও উন্মুক্ত ডেটার মাধ্যমে সাংবাদিকতা করা সম্ভব, যা জনগণের কাজে লাগবে।” চ্যানেল টোয়েন্টি ফোরের নির্বাহী পরিচালক তালাত মামুন বলেন, “দুর্নীতির আকার এখন বেড়েছে। আগে অল্প টাকার দুর্নীতি হতো, এখন অনেক টাকার দুর্নীতি হয়। দুর্নীতির পদ্ধতি পরিবর্তিত হয়েছে। তাই সাংবাদিতাকেও সেভাবে পরিবর্তিত হতে হবে; এগিয়ে যেতে হবে, এর কোনো বিকল্প নেই।”

বৈশাখী টেলিভিশনের প্ল্যানিং কনসালট্যান্ট জুলফিকার আলি মাণিক বলেন, “সাংবাদিকদের মাঝে ভয় সৃষ্টি হয়েছে এবং এর পেছনে ডিজিটাল সিকিউরিটি ও অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের মতো আইনের ভূমিকা আছে। কিন্তু সততা ও সাহসিকতা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।” গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম নেটওয়ার্কের বাংলা বিভাগের এডিটর মিরাজ আহমেদ চৌধুরী বলেন, “সাংবাদিকতায় ডেটা সাংবাদিকতা পরিবর্তন নিয়ে আসবে। সাংবাদিকতার কাজ কর্তৃপক্ষের জবাবদিহি নিশ্চিত করা এবং ডেটা সাংবাদিকতা সেটি নিশ্চিত করবে। দুর্নীতি বৈশ্বিক এবং এটিকে এখন খুঁজে বের করতে হলে ডেটা সাংবাদিকতার দক্ষতা থাকা জরুরি, এর মাধ্যমে সাংবাদিকতা দেশের সীমানা ছাড়াবে।”

অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা প্রতিযোগিতায় এমআরডিআই এর অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা হেল্প ডেস্কের প্রধান মোহাম্মদ বদরুদ্দোজা, নিউজ টোয়েন্টি ফোরের প্রধান বার্তা সম্পাদক শাহনাজ মুন্নী, ঢাকা ট্রিবিউনের নির্বাহী সম্পাদক রিয়াজ আহমেদ, বৈশাখী টেলিভিশনের প্ল্যানিং কনসালট্যান্ট জুলফিকার আলি মাণিক, একাত্তর টেলিভিশনের অ্যাসাইনমেন্ট এডিটর সুজন কবির ও দৈনিক বাংলার নির্বাহী সম্পাদক শরিফুজ্জামান পিন্টু বিচারকমণ্ডলীর দায়িত্ব পালন করেছেন।

আঞ্চলিক সংবাদপত্র বিভাগে ১৭টি, জাতীয় সংবাদপত্র বিভাগে ৪৫টি, টেলিভিশন বিভাগে ২৬টি ও প্রামাণ্য অনুষ্ঠান বিভাগে ১১টিসহ এ বছর টিআইবির অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা পুরস্কারের জন্য সর্বমোট ৯৯টি প্রতিবেদন জমা হয়। আঞ্চলিক সংবাদপত্র বিভাগে বিজয়ী হয়েছেন খুলনার ‘দৈনিক পূর্বাঞ্চল’ পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার আবুল হাসান হিমালয় (এইচ এম হিমালয়)। জাতীয় সংবাদপত্র বিভাগে বিজয়ী হয়েছেন ‘দৈনিক প্রথম আলো’ পত্রিকার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক আসাদুজ্জামান। টেলিভিশন বিভাগে বিজয়ী হয়েছেন যমুনা টেলিভিশনের ইনভেস্টিগেশন সেলের এডিটর অপূর্ব আলাউদ্দিন। বিজয়ীদের প্রত্যেককে সম্মাননাপত্র, ক্রেস্ট ও এক লক্ষ পঁচিশ হাজার টাকা পুরস্কার প্রদান করা হয়। প্রামাণ্য অনুষ্ঠান বিভাগে বিজয়ী হয়েছে চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের প্রামাণ্য অনুষ্ঠান ‘সার্চলাইট’। বিজয়ী প্রামাণ্য অনুষ্ঠানটির জন্য সম্মাননাপত্র, ক্রেস্ট ও এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার টাকার পুরস্কার প্রদান করা হয়।

একইদিন বিকাল ৩:০০টায় ‘দুর্নীতিবিরোধী কার্টুন প্রতিযোগিতা ২০২২’ এর পুরস্কার ঘোষণা এবং দুই সপ্তাহব্যাপী কার্টুন প্রদর্শনীর উদ্বোধন করা হয়। অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সুইজারল্যান্ড দূতাবাসের নেক্সাস ম্যানেজার আইরিন হফস্টেটার, ব্রিটিশ হাই কমিশনের গভর্ন্যান্স অ্যান্ড পলিটিক্যাল টিমের প্রধান টম বার্জ, সুইডেন দূতাবাসের সেকেন্ড সেক্রেটারি পাওলা ক্যাস্ট্র নিডারস্টাম এবং দুর্নীতিবিরোধী কার্টুন প্রতিযোগিতার বিচারক কার্টুনিস্ট ও উন্মাদ পত্রিকার সম্পাদক আহসান হাবিব। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন অধ্যাপক ড. পারভীন হাসান এবং স্বাগত বক্তব্য রাখেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।

শিক্ষা ও পেশাগত জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে তরুণদের দুর্নীতিবিরোধী চেতনা ধারণ করার আহŸান জানিয়ে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “দুর্নীতি প্রতিরোধ করতে হলে প্রত্যেকের অংশগ্রহণ জরুরি। তরুণদের আঁকা কার্টুনে এবার যেভাবে দুর্নীতির নেতিবাচক ও বৈষম্যমূলক প্রভাব তুলে ধরা হয়েছে, তা সকল শ্রেণীর জনগণকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে অনুপ্রাণিত করবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। তরুণদের কার্টুন প্রতিযোগিতাসহ বহুমূখী কার্যক্রমে অংশগ্রহনের সুযোগ সৃষ্টি করে টিআইবি বাংলাদেশ দুর্নীতিবিরোধী সামাজিক আন্দোলনকে আরো বেগবান করতে অঙ্গীকারবদ্ধ।”

সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক ড. পারভীন হাসান বলেন, “কার্টুনের মাধ্যমে অল্প কথায় অনেক কিছু বলে দেওয়া যায়। কার্টুন শুধু ছবি নয়, এটি প্রশ্ন করারও একটি মাধ্যম। প্রশ্ন করবার যে প্রবণতা সমাজে থাকার কথা, সেটির ঘাটতি এখন দেখা যায়। কিন্তু খুশির বিষয় যে, এই মাধ্যম ব্যবহার করে তরুণরা প্রশ্ন করছে, যা আমাদের অনুপ্রেরণা যোগায়।”

ধন্যবাদ জ্ঞাপন বক্তব্যে টিআইবির উপদেষ্টা- নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে, “তরুণরা বাংলাদেশেকে তাদের অনুপ্রেরণা ও সংগ্রামের মাধ্যমে সুশাসনের পর্যায়ে নিয়ে যাবে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে।”

সংক্ষিপ্ত বক্তব্য শেষে, বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়। ‘দুর্নীতি ও সুশাসন’ বিষয়কে উপজীব্য করে আয়োজিত ১৭তম কার্টুন প্রতিযোগিতায় ‘ক’ বিভাগে (১৩-১৮) প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অধিকার করেন যথাক্রমে রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের শিক্ষার্থী রাফসান যানি, মোঃ জুবায়ের ইসলাম শাফী ও তানভীর হাসান শুভ। এছাড়া, ‘খ’ বিভাগে (১৯-২৫) প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অধিকার করেন যথাক্রমে রাজন নন্দী, আব্দুলাহ আল যুনায়েদ ও ঐশিক জাওয়াদ। উভয় গ্রুপের বিজয়ী তিনজনকে যথাক্রমে ৭৫ হাজার, ৫০ হাজার ও ৪০ হাজার টাকার চেক, ক্রেস্ট ও সনদ প্রদান করা হয়। এ ছাড়া দু’টি বিভাগ থেকে মোট ৩৩ জন কার্টুনিস্টদের বিশেষ মনোনয়ন দেওয়া হয়। উল্লেখ্য, এছর দু’টি বিভাগে ১৮০ জন কার্টুনিস্টের আঁকা মোট ২৬৮টি কার্টুন জমা পড়ে। টিআইবির প্রধান কার্যালয়ে প্রতিযোগিতার সেরা ৪৮টি কার্টুন নিয়ে আজ থেকে দুই সপ্তাহব্যাপী (৯-২৩ ডিসেম্বর) বিকাল ১২:০০টা থেকে সন্ধ্যা ৭:০০টা পর্যন্ত টিআইবির ধানমন্ডিস্থ কার্যালয়ের লেভেল ৫- এ সবার জন্য উন্মুক্ত প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়া অনলাইনেও এই প্রদর্শনীটি চলবে।

 

গণমাধ্যম যোগাযোগ:
শেখ মনজুর-ই-আলম
পরিচালক (আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন)
মোবাইল: ০১৭০৮৪৯৫৩৯৫
ইমেইলঃ manjur@ti-bangladesh.org


Press Release