‘রেগুলেশন ফর ডিজিটাল, সোশ্যাল মিডিয়া অ্যান্ড ওটিটি প্ল্যাটফর্মস’ নীতিমালা সংবিধান পরিপন্থী যা বাকস্বাধীনতাকে মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন করবে

সংবাদ বিজ্ঞপ্তি

‘রেগুলেশন ফর ডিজিটাল, সোশ্যাল মিডিয়া অ্যান্ড ওটিটি প্ল্যাটফর্মস’নীতিমালা সংবিধান পরিপন্থী যা বাকস্বাধীনতাকে মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন করব; অংশীজন ও বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় নতুন একটি খসড়া প্রণয়নের দাবি টিআইবির

ঢাকা, ০৩ এপ্রিল ২০২২: ‘দ্য বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন রেগুলেশন ফর ডিজিটাল, সোশ্যাল মিডিয়া অ্যান্ড ওটিটি প্লাটফর্মস ২০২১’-নীতিমালার খসড়ার কয়েকটি ধারা সংবিধান পরিপন্থি। খসড়ার বেশ কয়েকটি ধারা বাকস্বাধীনতাকে মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন করবে এবং সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সেল্ফ সেন্সরশিপের চর্চা করতে বাধ্য হবে। পাশাপাশি কয়েকটি ধারাতে আইনের ইচ্ছামতো ব্যাখ্যা ও অপব্যবহারের সুযোগ আছে, যা জনগণের কণ্ঠরোধে ব্যবহৃত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিটিআরসির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত খসড়া নীতিমালা নিয়ে আয়োজিত ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে আজ এসব পর্যবেক্ষন তুলে ধরেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। খসড়াটিতে সংশ্লিষ্ট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে অযৌক্তিক নীতি কাঠামোর আওতায় এনে বার্তার উৎস সনাক্তকরণের (ট্রেসেবিলিটি) শর্ত প্রতিপালনে এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপশনের শর্ত ভাঙার যে অন্যায় সুবিধা তৈরি করা হচ্ছে তা ব্যক্তিগত যোগাযোগের গোপনীয়তার সংবিধান স্বীকৃত অধিকারকে খর্ব করবে বলেও মনে করছে সংস্থাটি। এরফলে সাংবাদিক, ভিন্নমতাবলম্বী ও অধিকারকর্মীরা বাড়তি ঝুঁকিতে পড়বেন।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের। খসড়া নীতিমালা নিয়ে টিআইবির অবস্থান উপস্থাপন করেন টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক শেখ মন্‌জুর-ই-আলম।

সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির পক্ষ থেকে বলা হয়, ধারা ৩-এ নীতিমালাটির উদ্দেশ্য যেভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, তা যতখানি না ইন্টারনেট বা অনলাইন সম্পর্কিত তার চেয়ে অধিকমাত্রায় টেলিকমিউনিকেশন ও সম্প্রচার সম্পর্কিত। নীতিমালার ৪ ও ৫ ধারায় নীতিমালার উদ্দেশ্যসমূহ ও ‘অনলাইন সেবাপ্রদানকারী ’সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন সনদ বা অনুমতি প্রাপ্তির ক্ষেত্রে যে সকল শর্তাবলী আরোপ করা হয়েছে, তা মূলত প্রচলিত টেলিকমিউনিকেশন সেবাপ্রদানকারী (ইন্টারনেট সেবাপ্রদানকারী ও মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটর) প্রতিষ্ঠানসমূহের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এক্ষেত্রে আরো দূরদর্শী ও সাবধানতার সঙ্গে অগ্রসর হওয়া জরুরি। কেননা, নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষকে প্রচলিত ধারার টেলিকমিউনিকেশন ও সম্প্রচার মাধ্যম নিয়ন্ত্রণের ধারণার বশবর্তী হয়ে “অনলাইন সেবার”মূল ভাবনার বিপরীত নীতি গ্রহণে উৎসাহিত করতে পারে।

নীতিমালায় নিবন্ধনের শর্ত অনুযায়ী ধরেই নেওয়া হচ্ছে যে, আবেদনকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ বাংলাদেশের ভৌগলিক সীমানার মধ্যে অবস্থান এবং প্রচলিত ধারার নিয়ম-নীতি ও পদ্ধতি অনুসরণ করেই আবেদন করবেন। কিন্তু দেশের বাইরে অবস্থিত প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধনের ক্ষেত্রে কোন পদ্ধতি বা নীতি অনুসৃত হবে, তা স্পষ্ট করে বলা হয়নি। এর ফলে, সংশ্লিষ্ট আগ্রহী প্রতিষ্ঠানসমূহকে উল্লিখিত নিয়ম মেনে আবেদন করার ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তার ঝুঁকি রয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, প্রচলিত ধারার টেলিকমিউনিকেশন সেবা প্রদান করার ক্ষেত্রে অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধার পাশাপাশি প্রশিক্ষিত জনবলেরও সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রয়োজন হয়। অন্যদিকে ইন্টারনেটভিত্তিক সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে কিন্তু এই দুটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান ছাড়াই সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহ দেশের ভৌগলিক সীমানার বাইরে অবস্থান করে এবং তৃতীয় কোনো পক্ষের সহযোগিতা ছাড়াই কেবলমাত্র বিদ্যমান টেলিকমিউনিকেশন কাঠামো ব্যবহার করেই কাঙ্খিত সেবা প্রদানে সক্ষম। সুতরাং, খসড়া নীতিমালার উল্লিখিত শর্তাবলীতে “ইন্টারনেটভিত্তিক সেবা প্রদানের”ধারণাকে যেভাবে নির্দিষ্ট ভৌগলিক সীমানা দিয়ে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, তা ভ্রান্তিমূলক, অসামঞ্জস্যপূর্ণ ও অযৌক্তিক। তাছাড়া, 'ইন্টারনেট`' সেবা প্রদানকারী”প্রতিষ্ঠানসমূহ যেভাবে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে, সে ধারণারও পরিপন্থী। এর ফলে স্থানীয় পর্যায়ের ভোক্তাকে দেশের ভৌগলিক সীমানার বাইরের প্রতিষ্ঠানসমূহ থেকে সেবাগ্রহণের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে, যা নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সেবাপ্রাপ্তিকে বাধাগ্রস্ত করার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের ব্যবসার খরচ বৃদ্ধি করবে।

টিআইবি মনে করে, ব্যবহারকারী কর্তৃক তৈরিকৃত আধেয় শুধুমাত্র প্রচার ও প্রকাশে সহায়তা করার কারণে মধ্যস্থতাকারীদের জন্য শাস্তির যে বিধান নির্ধারণ করা হয়েছে এবং তা থেকে নিস্কৃতি পেতে সুরক্ষাবলয়ের অনুপস্থিতি সংবিধান পরিপন্থী। মধ্যবর্তী সেবাদানকারী মাধ্যমের জন্য সুরক্ষা বিধান না করা হলে, জরিমানা এড়াতে তারা “আত্ম-নিয়ন্ত্রণের”জায়গা থেকে আধেয় পরিবেশনে অতিরিক্ত মাত্রায় সাবধানতা অবলম্বন করবে, এর ফলে স্বাধীন মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে অযাচিত প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হবে, যা সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে স্বীকৃত মৌলিক অধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

এছাড়াও সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, একই বিষয় নিয়ে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রনালয় এবং বিটিআরসি পৃথক নীতিমালা প্রণয়ন করছে। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় “ওভার দ্য টপ (ওটিটি) কনটেন্টভিত্তিক পরিষেবা প্রদান এবং পরিচালনা নীতিমালা-২০২১ (খসড়া) তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে। একই বিষয়ের ওপর বিটিআরসি এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় পৃথকভাবে কেন নীতিমালা প্রণয়ন করছে এবং একই ক্ষেত্রে দুটি পৃথক সংস্থা প্রণীত নীতিমালা কীভাবে বাস্তবায়ন ও কার্যকর করা হবে, সে ব্যাপারে সুস্পষ্ট কোনো নির্দেশনাবলী উল্লেখ না থাকায় টিআইবি উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সর্বোপরি তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রনালয়ের ইন্টারনেটভিত্তিক পরিষেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানসমূহকে নিয়ন্ত্রণ করার মতো যথেষ্ট আইনি সক্ষমতা আছে কী-না, তা নিয়েও প্রশ্নের অবকাশ রয়েছে।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “নীতিমালাটির মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিৎ একদিকে যেমনডিজিটাল, সোশ্যাল মিডিয়া ও ওটিটি প্ল্যাটফর্মের ক্ষতিকর কন্টেন্ট নিয়ন্ত্রণ করা, অন্যদিকে তেমন জনগণ যাতে এই প্ল্যাটফর্ম নিরাপদে ব্যবহার করে সংবিধানসম্মতভাবে বাক স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার প্রয়োগের নিশ্চয়তা পায় তার বিধান করা। কন্টেন্ট নিয়ন্ত্রণের নামে ভারসাম্যহীন প্রতিবন্ধকতা চাপিয়ে দিয়ে ডিজিটাল, সোশ্যাল মিডিয়া ও ওটিটি প্ল্যাটফর্মে সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের জন্য উপযোগী পরিবেশ বিনষ্ট করা হলে তা হবে ‘মাথা ব্যাথার কারণে মাথা কেটে ফেলা’র নামান্তর।”

ড. জামান আরও বলেন, “নীতিমালায় শুধুমাত্র নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হয়েছে এবং এর কোনো কোনো ধারা যেমন- বার্তা প্রাপক ও প্রাপক শনাক্তকরণ এবং ঢালাওভাবে কন্টেন্ট অপসারণের বাধ্যবাধকতা, বহুমতভিত্তিক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নে ঝুঁকি সৃষ্টি করবে। এছাড়া পরস্পরবিরোধী ধারার পাশাপাশি অনেক ক্ষেত্রে ব্যবহৃত শব্দপুঞ্জের সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা বা ব্যাখ্যা না থাকায় এই নীতিমালার অপব্যবহারেরও সুযোগ রয়েছে। খসড়া নীতিমালায় এমন কিছু ধারা রয়েছে যা বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ একটি নজরদারিভিত্তিক রাষ্ট্রে পরিণত হবে। ডিজিটাল বাংলাদেশের যে অঙ্গীকার ও সম্ভাবনা, তার সাথে এই খসড়া নীতিমালা কতটুকু সামঞ্জস্যপূর্ণ তা খতিয়ে দেখা অপরিহার্য। আমাদের পরামর্শ হচ্ছে-অন্যান্য দেশের ইতিবাচক চর্চার অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা এবং বাংলাদেশের বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ ও অংশীজনকে সম্পৃক্ত করে খসড়া নীতিমালাটিকে ঢেলে সাজানো।”

অংশীজন ও বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় নতুন একটি খসড়া প্রণয়নের দাবি জানিয়ে টিআইবি কিছু সুপারিশ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে- খসড়া নীতিমালাটির প্রয়োগ শুধুমাত্র বাংলাদেশের ভৌগলিক সীমানার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা এবং ‘ইন্টারনেটভিত্তিক সেবাপ্রদানকারী’, ‘সেবা’অথবা ‘অ্যাপ্লিকেশন’ধারণাসমূহের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা ও সংজ্ঞায়ন করা; মহামান্য হাইকোর্টের সম্মতি, বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০০১ (২০০১ আইন) এর ৯৯ ধারায় বর্ণিত প্রক্রিয়া যথাযথভাবে অনুসৃত হওয়া এবং প্রজ্ঞাপন জারির কমপক্ষে দুই বছর অতিবাহিত হলে খসড়া নীতিমালাটি কার্যকর করা; অনলাইনের ক্ষতিকর দিক নিয়ন্ত্রণ, ক্ষতিকর আধেয় থেকে ভোক্তা, নিত্য ঝুঁকির সম্মুখীন হওয়া জনগোষ্ঠী (নারী, শিশু, গণমাধ্যমকর্মী, সরকার বা কর্তৃপক্ষের সমালোচনাকারী)-কে সুরক্ষা প্রদান, সুবিন্যস্ত ও সুশৃঙ্খলভাবে আধেয় পরিবেশনের স্বার্থে ‘সেবাপ্রদানকারীর’সৃজনশীলতাকে সুরক্ষা প্রদান, ব্যক্তি অধিকার, বাক্ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ন্যায় মৌলিক অধিকারসমূহের সুরক্ষা প্রদান, বাংলাদেশের ভৌগলিক সীমানার ভিতরে ও বাইরে অবস্থানকারী উভয় ধরনের সেবাপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠানকে সমভাবে সুযোগ প্রদান ও মূল্যায়ন, সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ক্ষতিপূরণ বাপ্রতিকারের বিধান নিশ্চিত করা, অপ্রাপ্ত বয়স্ক ব্যবহারকারীদের স্বার্থ রক্ষায় অনলাইন আধেয়-এর ক্ষেত্রে অভিভাবকদের নিয়ন্ত্রণের সুযোগ নিশ্চিত করা,মেধাস্বত্ব মালিকানা/অধিকার-এর সুরক্ষা প্রদান ইত্যাদি। সুপারিশমালায় আরও রয়েছেস্থানীয়ভাবে অন্তর্ভুক্তি বা নিবন্ধন, আবাসিক কর্মকর্তা এবং স্থানীয় প্রতিনিধি নিয়োগের বাধ্যবাধকতাসংশ্লিষ্ট ধারাসমূহ খসড়া নীতিমালা থেকে সম্পূর্ণভাবে বাদ দেওয়া; যৌক্তিক কারণ ব্যতিরেকে আধেয় কাটছাঁটের ঘটনা রোধে প্রক্রিয়াগত সুরক্ষাবলয় নিশ্চিত করা; নির্দেশনা অনুযায়ী আধেয় অপসারণে অপারগ বা ব্যর্থ হলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে পর্যায়ক্রমিক ও আনুপাতিক প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা ইত্যাদি।

গণমাধ্যম যোগাযোগ:
শেখ মন্জুর-ই-আলম
পরিচালক, আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন
মোবাইল: ০১৭০৮৪৯৫৩৯৫
ই-মেইল: manjur@ti-bangladesh.org


Press Release