সংবাদ বিজ্ঞপ্তি
ঢাকা, ৯ ডিসেম্বর ২০২০: জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে দুর্নীতিবিরোধী বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে প্রতিবছরের ন্যায় এবারও ৯ ডিসেম্বর জাতিসংঘ ঘোষিত আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস উদযাপন করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। ‘করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় দুর্নীতির প্রতি শুন্য সহনশীলতা: দুর্নীতি থামাও, জীবন বাঁচাও’ এই প্রতিপাদ্যে দিবসটি উদযাপন করছে সংস্থাটি। জাতীয় পর্যায়ে ইতোমধ্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় বিতর্ক সংগঠন জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটি ডিবেট অর্গানাইজেশন (জেইউডিও)-এর সাথে যৌথভাবে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে আন্তর্জাতিক বিতর্ক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এছাড়া করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় স্থানীয় পর্যায়ে টিআইবির অনুপ্রেরণায় ৪৫টি অঞ্চলে গঠিত সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক), স্বচ্ছতার জন্য নাগরিক (স্বজন), ইয়ুথ এনগেজমেন্ট অ্যান্ড সাপোর্ট (ইয়েস) এবং ইয়েস ফ্রেন্ডস গ্রুপের আয়োজনে অনলাইনে নানা ধরনের কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে।
জাতীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে আজ সকাল ১১.০০ টায় অনলাইনে ‘দুর্নীতিবিরোধী সামাজিক আন্দোলনে তারুণ্য: কার্টুন ও চিত্রশিল্প’ শীর্ষক একটি আলোচনা এবং ১৫তম দুর্নীতিবিরোধী কার্টুন প্রতিযোগিতার পুরস্কার ঘোষণা ও অনলাইন প্রদর্শনীর উদ্বোধন করা হয়। টিআইবির বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারপারসন ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. পারভীন হাসান-এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। এসময় আলোচনায় অংশ নেন টিআইবি’র ন্যায়পাল ও কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, টিআইবির বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সদস্য এবং লেখক ও সাংবাদিক আবুল মোমেন, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের অংকন ও চিত্রায়ন বিভাগের অধ্যাপক ও কার্টুনিস্ট শিশির ভট্টাচার্য এবং দ্যা বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক ও কার্টুনিস্ট শাহরিয়ার খান। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক শেখ মনজুর-ই-আলম। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন টিআইবির উপদেষ্টা- নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিনিধি এবং কার্টুন প্রতিযোগিতার কার্টুনিস্টবৃন্দ।
স্বাগত বক্তব্যে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “আজ আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস হলেও টিআইবির জন্য প্রতিটি দিনই দুর্নীতিবিরোধী দিবস। তরুণ স্বেচ্ছাসেবীদের নিয়ে যেসব মাধ্যম ব্যবহার করে টিআইবি দুর্নীতিবিরোধী সামাজিক আন্দোলন করে যাচ্ছে তার মধ্যে সাংস্কৃতিক মাধ্যম অন্যতম। কবিতা, গান, গল্প, নাটিকা, সংস্কৃতি মেলার পাশাপাশি ২০০৬ সাল থেকে কার্টুন প্রতিযোগিতা এই মাধ্যমের প্রধানতম অনুষঙ্গ, যা আন্তর্জাতিকভাবেও স্বীকৃতি পেয়েছে। এবারের প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়া তরুণ সব কার্টুনিস্টদের অভিনন্দন।”
আলোচনায় অংশ নিয়ে টিআইবি’র ন্যায়পাল ও কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, “দুর্নীতির বিরুদ্ধে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করতে হলে এটি শুধু পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভূক্ত করলেই হবে না, এটি দৈনন্দিন জীবনযাপনের অংশ করতে হবে। তাই ছবি বা কার্টুন আঁকার মধ্য দিয়ে তরুণরা যখন এই দায়িত্বটা নিয়ে নেয়, তারা শুধু নিজেরাই অংশগ্রহণই করে না বরং পরিবারের সবাইকে অংশগ্রহণ করায়, বন্ধুবান্ধব ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়। তাতে অন্তত একটা সামাজিক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। তরুণদের এই সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে অংশগ্রহণের ফলাফলটা সুদূরপ্রসারী। এর মধ্য দিয়ে নিরব বিপ্লব সাধিত হয়; মানুষের মধ্যে একটা অন্তর্গত পরিবর্তন ঘটে, যেটি অত্যন্ত জরুরি।” করোনা ভাইরাসের সংক্রমনের শুরুর দিকে দুর্নীতির একটা উৎসব শুরু হয়েছিল মন্তব্য করে তিনি আরো বলেন, “তরুণরা যখন সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে এসব দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলা শুরু করে তখন এর মাত্রা কিছুটা কমে আসে। করোনার প্রতিষেধক যখন আসবে তখন এই দুর্নীতির মাত্রা আবার বাড়বে। তাই তরুণরা যদি তখন প্রতিষেধক নিয়ে হতে যাওয়া দুর্নীতির বিরুদ্ধে না সোচ্চার না হয় তাহলে এই প্রতিষেধক কোনদিন দরিদ্র মানুষের কাছে যথাযথভাবে পৌঁছাবে না।”
কার্টুনিস্ট শাহরিয়ার খান বলেন, “টিআইবির কার্টুন প্রতিযোগিতা এখন অনেক বেশি ছড়িয়ে গেছে। এই প্রতিযোগিতায় ১৩ বছরের বাচ্চা থেকে ২৫ বছর পর্যন্ত অংশগ্রহণকারী সকলেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাদের চিন্তা ভাবনার প্রকাশ ঘটায়। এক্ষেত্রে টিআইবির স্বার্থকতা হলো, তরুণদের মধ্যে এই প্রতিযোগিতা একটি সাড়া তৈরি করতে পেরেছে। এই কার্টুনিস্টদের মধ্যে পরবর্তীতে অনেকেই বিভিন্ন মিডিয়াতে কাজ করছেন এবং একে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। এর মাধ্যমে একধরণের সামাজিক আন্দোলন গড়ে উঠেছে। আশা করছি, এই প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে টিআইবির দুর্নীতিবিরোধী বার্তা সমাজে আরো ভালভাবে ছড়িয়ে পড়বে।”
অধ্যাপক শিশির ভট্টাচার্য বলেন, “এই প্রতিযোগিতা শুধু কার্টুন আঁকাই নয়, বরং এক ধরণের সচেতনতা তৈরি করছে। এই সচেতনতা পাঠ্যবই পড়ে হয় না। এর জন্য সংস্কৃতি দরকার, পারিবারিক শিক্ষা দরকার, চোখ-কান খোলা রাখা দরকার। দুর্নীতি যে খারাপ বিষয় তা কার্টুনের মাধ্যমেই একজন কার্টুনিস্ট তুলে ধরেন। অনেক জরুরি বিষয় লিখে যতটা বোঝানো যায়, তা কিন্তু কার্টুনের ভাষায়, ছবির ভাষায় ৮০ শতাংশ মানুষকে আরো ভালোভাবে বোঝানো সম্ভব। একজন প্রতিযোগী যখন কার্টুন আঁকার মধ্য দিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা প্রকাশ করে এবং নাগরিক হিসেবে সেই উপলব্ধি যদি সে তার জীবনাচারণে এবং কর্মজীবনে ধরে রাখে, তাহলে এই সচেতনতা থেকে ভাল কিছুই হচ্ছে। এই দেশকে যারা কুলষিত করছে, নষ্ট করছে তাদের হাত থেকে রক্ষা করতে টিআইবির এই উদ্যোগ দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে কার্যকর হাতিয়ার হতে পারে।”
টিআইবির বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সদস্য এবং লেখক ও সাংবাদিক আবুল মোমেন বলেন, “দুর্নীতি যে করছে তার পেছনে একটি দুর্নীতিবাজ মন কাজ করছে। আমাদের সমাজ দুর্নীতির প্রতি অনেক বেশি সহনশীল। একজন দুর্নীতিগ্রস্ত লোককে তারা ভোট দিয়ে নির্বাচিত করছে। আমরা চাচ্ছি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হোক। কিন্তু এই গণতন্ত্রের মাধ্যমে তারা নির্বাচিত হয়ে সংসদে চলে যাচ্ছে। এখানে সমাজ কোন রকম ছাঁকনির কাজ করছে না। এখানে সুনীতি ও দুর্নীতি মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। আমাদের পরিবার, সমাজ এবং রাজনীতিও এখানে একটি ধোঁয়াশা তৈরি করে রেখেছে। সবাই মিলে মিশেই আমরা দুর্নীতিকে লালন করছি। আমরা কখনোই চাই না যে, সমাজে দুর্নীতি বিষয়ে কার্টুন আঁকার মত অনুষঙ্গ টিকে থাকুক। তাই আমাদের সমাজকে, শিক্ষাব্যবস্থাকে আমরা এমনভাবে ঢেলে সাজাতে চাই, যাতে মানুষের সুকুমার বৃত্তিগুলো সঠিকভাবে বিকশিত হয়, সমাজ থেকে সকল অন্যায়, দুর্নীতি বিদায় নেয়।”
সভাপতির বক্তব্যে টিআইবির বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারপারসন ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. পারভীন হাসান বলেন, “একটি জাতি কতটুকু সভ্য তা তাদের শিল্পকলার চর্চা থেকে বোঝা যায়। অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হলে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড বৃদ্ধি করতে হবে। তাই তরুণদের ছাড়া দুর্নীতির বৃত্ত থেকে আমাদের বের হবার কোন উপায় নেই। দুর্নীতিবিরোধী এই কার্টুন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারীদের মত তরুণ-যুবাদের ওপরই আমাদের ভরসা রাখতে হবে। কারণ পরিবার, শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে শুরু করে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি জেঁকে বসেছে। আমাদের মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে হবে। আমাদের ব্রত নিতে হবে যে আমরা নিজেরা কখনো দুর্নীতি করবো না। নিজের জীবনে দুর্নীতিকে না বললে আমরা সুন্দর একটা দেশ পাবো, একটি সুন্দর সমাজ হবে।”
আলোচনা শেষে টিআইবির ১৫তম দুর্নীতিবিরোধী কার্টুন প্রতিযোগিতা ২০২০-এর পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। এবার ‘করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় দুর্নীতি’ বিষয়ে আয়োজিত এই কার্টুন প্রতিযোগিতায় ‘ক’ বিভাগে (১৩-১৮ বছর) ১ম, ২য় ও ৩য় স্থান অধিকার করেন যথাক্রমে কুমিল্লা ক্যাডেট কলেজের শিক্ষার্থী মো: ইসমাঈল মাহমুদ, নোয়াখালী সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী আসিফ মোহাম্মদ ইউছুফ এবং বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল এন্ড কলেজ (বিআইএসটি)-এর শিক্ষার্থী তাসনিম সামিহা ইসলাম। আর ‘খ’ বিভাগে (১৯-২৫ বছর) ১ম, ২য় ও ৩য় স্থান অধিকার করেন যথাক্রমে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের অংকন ও চিত্রায়ন বিভাগের শিক্ষার্থী মাহাতাব রশীদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী দুরন্ত সাদাত মাহবুব এবং ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের অংকন ও চিত্রায়ন বিভাগের শিক্ষার্থী শিক্ষার্থী রাহুল রাজ দেবনাথ। উভয় গ্রুপের বিজয়ী তিনজনকে যথাক্রমে ৭৫ হাজার, ৫০ হাজার ও ৪০ হাজার টাকার চেক, ক্রেস্ট ও সনদ প্রদান করা হয়। এছাড়া দু’টি বিভাগ থেকে মোট ৪২ জন কার্টুনিস্টকে বিশেষ মনোনয়ন দেওয়া হয়। উল্লেখ্য, এছর দু’টি বিভাগে ১৩০ জন কার্টুনিস্টের আঁকা মোট ২৮৭টি কার্টুন জমা পড়ে। কার্টুন প্রতিযোগিতার বিজয়ী ও বিশেষ মনোনয়নপ্রাপ্ত ৪৮জন কার্টুনিস্টের মোট ৮০টি কার্টুন নিয়ে আজ থেকে অনলাইনে বিশেষ প্রদর্শনী চলবে।
গণমাধ্যম যোগাযোগ:
শেখ মনজুর-ই-আলম
পরিচালক (আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন)
মোবাইল: ০১৭০৮৪৯৫৩৯৫
ই-মেইল: manjur@ti-bangladesh.org