সংবাদ বিজ্ঞপ্তি
অনিয়ম ও সমন্বয়হীনতার কারণে ঢাকাসহ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে ডেঙ্গু, জড়িতদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার আহ্বান; পনের দফা সুপারিশ টিআইবির
ঢাকা, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯: বাংলাদেশে বিগত কয়েক বছর ধরে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব থাকলেও জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে ডেঙ্গু মশা নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধকে গুরুত্ব না দেওয়া; সমন্বিত ব্যবস্থাপনা না রেখে দুই সিটি কর্পোরেশনের কার্যক্রম শুধু রাসায়নিক ব্যবস্থাপনা-কেন্দ্রিক ও যথাযথভাবে সরকারি ক্রয় আইন অনুসরণ না করে কীটনাশক ক্রয়-নির্ভর হওয়ায় দুর্নীতির ক্ষেত্র তৈরি; বিক্ষিপ্তভাবে লোক দেখানো কার্যক্রম গ্রহণ এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য অংশীজনের মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে সীমাবদ্ধতা, অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে সারা দেশে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ায় লক্ষাধিক মানুষের ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়া এবং দুই শতাধিক মানুষের মৃত্যুর কারণ বলে মন্তব্য করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। জড়িতদের জবাবদিহিতার আওতায় আনাসহ ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় পনের দফা সুপারিশ করছে সংস্থাটি।
‘ঢাকা শহরে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আজ টিআইবির ধানমন্ডিস্থ কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে দুই (ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ) সিটি কর্পোরেশনের ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে এই সুপারিশসমূহ উপস্থাপন করে টিআইবি। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবি নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্ট-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের এবং গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান। টিআইবির গবেষণা ও পলিসি বিভাগের সিনিয়র গ্রোগ্রাম ম্যানেজার শাহজাদা এম আকরামের তত্ত্বাবধানে গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রণয়ন ও উপস্থাপন করেন ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার মো. জুলকারনাইন ও মো. মোস্তফা কামাল।
বাংলাদেশে বিশেষত ঢাকায় ২০০০ সাল থেকে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব হওয়া সত্ত্বেও ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম কতটুকু কার্যকর হচ্ছে এবং কার্যকর না হলে কেন হচ্ছে না তা নিয়ে অনুসন্ধানী গবেষণার প্রয়োজনীয়তা থেকে এই গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে। যার সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যসমূহ হলো- ঢাকা শহরে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের বিভিন্ন ধাপের কার্যক্রম পর্যালোচনা; বিদ্যমান অনিয়ম-দুর্নীতির ধরন ও কারণ চিহ্নিত করা; সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের মধ্যে সমন্বয় পর্যালোচনা এবং বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সুপারিশ প্রদান করা। আগাম পূর্বাভাসকে গুরুত্ব না দেওয়া, ডেঙ্গুর প্রকৃত চিত্র চিহ্নিত করায় ঘাটতি, এলাকাভিত্তিক বা আঞ্চলিক পরিকল্পনা না থাকা, মশা নিয়ন্ত্রণে সকল পদ্ধতির সমন্বয় না করা, উপযুক্ত কীটনাশক নির্ধারণ না করা, বার্ষিক ক্রয় পরিকল্পনায় অনিয়ম, দরপত্রের নথি/দলিল প্রস্তুতিতে অনিয়ম, দরপত্র পদ্ধতিতে অনিয়ম, দরপত্র পদ্ধতির ফলে আর্থিক ক্ষতি, দরপত্রের দলিল প্রক্রিয়াকরণ ও কার্যাদেশ প্রদানে অনিয়ম, কীটনাশকের মাঠ পর্যায়ের কার্যকরতা পরীক্ষায় অনিয়ম, কীটনাশকের কার্যকরতা পরীক্ষার সীমাবদ্ধতা, কীটনাশকের নিবন্ধনে অনিয়ম ও দুর্নীতি, মশক নিধন কার্যক্রমে অনিয়ম-দুর্নীতি, দায়িত্ব পালনে অবহেলা, অপ্রয়োজনীয় ও লোক দেখানো ব্যবস্থা গ্রহণ, অবকাঠামো, যন্ত্রপাতির এবং প্রশিক্ষিত জনবলের ঘাটতি, বিভিন্ন অংশীজনের সমন্বয়, পরিকল্পনায় অংশগ্রহণের সুযোগের ঘাটতি প্রভৃতি বিষয় এই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
গবেষণা লব্ধ তথ্য মতে, ডেঙ্গুর ব্যাপকতাকে স্বীকার করে দুই সিটি কর্পোরেশন ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য অংশীজন কর্তৃক বিলম্বে হলেও কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেন যেমন- উত্তর সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক কীটনাশক সরবরাহকারী একটি প্রতিষ্ঠানকে ৫ মাসের জন্য কালো তালিকাভুক্তকরণ; বিতর্কিতভাবে বন্ধ রাখা কিছু জনস্বাস্থ্য কীটনাশকের আমদানি প্রক্রিয়া পুনরায় উন্মুক্তকরণ; নতুন কীটনাশক ক্রয়ের জন্য উভয় সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের কারিগরী উপদেষ্টা কমিটি গঠন; বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তাদের মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করা; ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক ‘ওয়ার্ড ডেঙ্গু প্রতিরোধ সেল’ গঠন; নতুন কীটনাশক আমদানি ও প্রয়োগ; ডেঙ্গু মশার উৎস ধ্বংসে ‘চিরুনি অভিযান’; ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা ও জরিমানা আরোপ এবং বিশেষজ্ঞদের অংশগ্রহণ ও মতামতের ভিত্তিতে ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিচালনা করা এবং ভবিষ্যত কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের উদ্যোগ।
গবেষণা থেকে জানা যায় যে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ডেঙ্গুর প্রকোপ রোধে আগাম পূর্বাভাসকে গুরুত্ব দেয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। যেমন- কীটনাশকের কার্যকরতা নিয়ে আইসিডিডিআর,বি- একটি গবেষণায় (মে ২০১৮) কয়েকটি কীটনাশকের সহনশীলতা (Resistance) পরীক্ষায় পারমিথ্রিনে এডিস ও কিউলেক্স মশার মধ্যে অতি উচ্চ মাত্রায় কীটনাশক সহনশীলতা দেখা যায়। এক্ষেত্রে কার্যকর ওষুধ হিসেবে ‘বেন্ডিওকার্ব’ নিবন্ধন না হওয়া পর্যন্ত ম্যালাথিউন বা ডেল্টামেথ্রিন ব্যবহারের পরামর্শ প্রদান করে। কিন্তু জাতীয় নির্বাচনের বছর হওয়ার কারণে একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা আইসিডিডিআর,বির- এই গবেষণার তথ্য গণমাধ্যমে প্রকাশ না করার জন্য নির্দেশ দেন বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। পরবর্তীতে আইসিডিডিআর,বির গবেষণা পদ্ধতি ও গবেষণা করার এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন এবং প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে কীটনাশক সহনশীলতা পরীক্ষা না করেই ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জন্য উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন যথাক্রমে ১৪ কোটি এবং ১৭.৩৯ কোটি টাকার একই কীটনাশক (পারমিথ্রিন) (জ্বালানিসহ) পুনরায় ক্রয় করে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত ডেঙ্গুর ভয়াবহতাকে গুরুত্ব না দিয়ে সিটি কর্পোরেশনসহ সরকারের একাধিক দায়িত্বশীল ব্যক্তি একে ‘গুজব’ বলে অভিহিত করেন। এডিস মশার উৎস গৃহস্থালীতে বেশি উল্লেখ করে ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাবের দায় জনগণের ওপর চাপানো হয়, যদিও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিশেষ মশা জরিপে সবচেয়ে বেশি এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যায় বাস টার্মিনাল, বাস ডিপোর পরিত্যক্ত টায়ারে ও রেলস্টেশনে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী এডিস মশার জরিপ শুধুমাত্র ঢাকা-কেন্দ্রিক হওয়ায় ঢাকার বাইরে অন্যান্য জেলায় আগাম সতর্কবার্তা দেওয়া সম্ভব হয়নি। পাশাপাশি, ডেঙ্গুর প্রকৃত চিত্র চিহ্নিত করায় ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর শুধুমাত্র হাসপাতালে ভর্তি হওয়া সংখ্যা বিবেচনা করে- সক্ষমতার ঘাটতির কারণে ঢাকায় সকল সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের মধ্যে মাত্র ৪১টির তথ্য সংকলন করা হয়; রোগ-নির্ণয় কেন্দ্রগুলো থেকে পরীক্ষায় নিশ্চিত হওয়া ডেঙ্গু রোগী- যারা আক্রান্ত হয়েছে কিন্তু হাসপাতালে ভর্তি হয়নি, তাদের তথ্য সংকলন করা হয়নি; উল্লেখ্য, ঢাকায় শুধু বেসরকারি হাসপাতালের সংখ্যাই প্রায় ৬ শতাধিক; এবং রোগ-নির্ণয় কেন্দ্রের সংখ্যা প্রায় ১০০০। খণ্ডিত পরিসংখ্যান দিয়ে অন্যান্য দেশের ডেঙ্গু আক্রান্তের হারের সাথে তুলনামূলক চিত্র দিয়ে ডেঙ্গু পরিস্থিতির মাত্রা কম দেখানো হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এলাকাভিত্তিক বা আঞ্চলিক পরিকল্পনা না থাকা এবং মশা নিয়ন্ত্রণে সকল পদ্ধতির সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ ও ক্রয়ের সুযোগ বেশি থাকায় দুর্নীতির সুযোগ তৈরি হয় বিধায় দুই সিটি কর্পোরেশনের কার্যক্রম সব সময় অ্যাডাল্টিসাইড কেন্দ্রিক বলে পরিলক্ষিত হয়েছে। অ্যাডাল্টিসাইডের চেয়ে লার্ভিসাইড এবং উৎস নির্মূল অনেক বেশি কার্যকর ও স্বল্প খরচের।
উভয় সিটি কর্পোরেশনেই উপযুক্ত কীটনাশক নির্ধারণ না করার অভিযোগ উঠে এসেছে প্রতিবেদনে। বিশেষজ্ঞ ছাড়াই কীটনাশক নির্ধারণ, উপযুক্ত কীটনাশক নির্বাচনে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের গবেষণাকে আমলে না নিয়ে একই কীটনাশক বারবার ক্রয়, এক সিটি কর্পোরেশনের কালো তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান থেকে অন্য সিটি কর্পোরেশনের বাতিল করা কীটনাশক ক্রয় এবং পরিকল্পনা ছাড়াই কীটনাশকের মেশিন ক্রয় করার অভিযোগ রয়েছে। ‘কীটনাশক আইন ২০১৮ (ধারা ৪)’ অনুযায়ী উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইং- এর অধীনে নিবন্ধিত নয় এমন একটি প্রতিষ্ঠানকে (ডকইয়ার্ড অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস লিমিটেড, নারায়ণগঞ্জকে) সরাসরি কার্যাদেশ প্রদান করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। প্রতি লিটার কীটনাশক ৩৭৮ টাকায় সরাসরি ক্রয়ের কার্যাদেশ দেওয়ায় প্রতি লিটার কীটনাশক ক্রয়ে ১৬১ টাকা ক্ষতি হয়েছে (কারণ তারা লিমিট এগ্রোপ্রোডাক্ট নামে যে প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে এই কীটনাশক ক্রয় করে সেই একই প্রতিষ্ঠান উত্তর সিটির উন্মুক্ত দরপত্রে একই কীটনাশকের জন্য প্রতি লিটারের দর ২১৭ টাকা প্রস্তাব করে) - এই হিসাবে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ক্রয়মূল্যের প্রায় ৪০ শতাংশ পর্যন্ত আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।
গবেষণায় দেখা যায় যে, কীটনাশক ক্রয়ের বিল উত্তোলন থেকে শুরু করে গুদামে পণ্য সরবরাহ পর্যন্ত ধাপে ধাপে কমিশন আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। দুই সিটি কর্পোরেশনেরই কীটনাশক প্রতিরোধী ক্ষমতা পরীক্ষা করানো বা কীটনাশক পরিবর্তন করার কোনো উদ্যোগ ছিল না। সিটি কর্পোরেশনের নিজস্ব কোনো ল্যাবরেটরি ও কীটতত্ত¡বিদ নেই। কোনো কীটতত্ত্ববিদ ছাড়াই আইইডিসিআর এর কীটতত্ত্ব বিভাগ চলছে; চিকিৎসক দিয়ে কীটনাশকের কার্যকারতা পরীক্ষা করানো হতো; তবে বর্তমানে এই জরুরী পরিস্থিতিতে একজন কীটতত্ত্ববিদ সাময়িকভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া, কীটনাশকের কার্যকরতা পরীক্ষায় অনিয়ম-দুর্নীতি সংঘটিত হয়ে থাকে, যেমন নিয়ম-বহির্ভূত অর্থের মাধ্যমে কার্যকরতার সনদ প্রদান, ঢাকার বাইরে থেকে কীটনাশক প্রতিরোধী নয় এমন মশা নিয়ে এসে পরীক্ষা, ক্ষেত্রবিশেষে পরীক্ষা না করেই প্রতিবেদন দেওয়া ইত্যাদি।
কীটনাশক ও ফগার মেশিনের জ্বালানি ব্যবহার না করে বাজারে বিক্রি করে দেওয়া; লার্ভিসাইড ব্যবহার না করে ফেলে দেওয়া; ভবনের নিচ তলায় বা গ্যারেজে ফগিং করার জন্য টাকা (৫০-২০০ টাকা) নেওয়া; দুই সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে জনঅংশগ্রহণের উদ্যোগ নেওয়ার ক্ষেত্রে ঘাটতি; ঢাকার বাইরে যাতে ডেঙ্গু সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়তে না পারে সেজন্য বাস, ট্রেন ও লঞ্চে মশার স্প্রে করার কথা থাকলেও তা না করা; নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে নিয়মিতভাবে ফগিং না করা এবং অপ্রয়োজনীয় ও লোক দেখানো কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ যেমন- হোল্ডিং করদাতাদের জন্য এরোসল ক্রয়, ডেঙ্গু মশার অ্যাপ তৈরি ও গণমাধ্যমে প্রচারের জন্য পরিষ্কার সড়কে ‘বর্জ্য পরিষ্কার’ করা এবং ফগিং করার চিত্র উঠে এসেছে গবেষণা প্রতিবেদনে। দুই সিটি কর্পোরেশন শুধু সাধারণ কিউলেক্স মশাকে লক্ষ্য করে এর কার্যক্রম পরিচালনা করে; এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের অন্যতম উপায় হচ্ছে এডিস মশার উৎস নির্মূল, কিন্তু এই বছরের ব্যাপক প্রাদুর্ভাবের আগে এডিস মশার উৎস নির্মূলের জন্য কোনো কার্যক্রম নেওয়া হয়নি।
গবেষণায় দেখা যায় প্রশিক্ষিত জনবলের ঘাটতি, অবকাঠামো ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির অভাবে মশার কীটনাশক দেওয়া এবং উৎস নির্মূলের কাজ যথাযথভাবে হচ্ছে কিনা তা মনিটরিং করার কার্যক্রম খুবই দুর্বল। দুই সিটিতে গড়ে ওয়ার্ড প্রতি ৫ জন মশক নিধন কর্মী যা মশক নিধন বিশেষত এডিস মশার উৎস নির্মূলের জন্য অপ্রতুল; উল্লেখ্য কলকাতা পৌরসংস্থায় প্রতি ওয়ার্ডের জন্য গড়ে ১৫ জন কর্মী রয়েছে। ২০১৮ সালে উত্তর সিটির ৬৫২টি মেশিনের মধ্যে অর্ধেক মেশিন নষ্ট ছিল- বর্তমানে জরুরি পরিস্থিতিতে নতুন কিছু মেশিন ক্রয় করা ও কিছু মেশিন মেরামত করা হলেও এখনো ৪০-৪৫টি মেশিন নষ্ট। পক্ষান্তরে দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ৯৪০টি মেশিনের মধ্যে ৪২৮টি মেশিন নষ্ট ছিল (হ্যান্ডেলড মেশিন ৪৪২টির মধ্যে ২০৮টি, ফগার মেশিন ৪৪৭টির মধ্যে ২০২টি নষ্ট এবং হুইলব্যারো ৫১টির মধ্যে ১৮টি নষ্ট)। এছাড়া, অধিকাংশ নষ্ট মেশিনের যন্ত্রাংশ বাংলাদেশে পাওয়া যায় না। যন্ত্রপাতির অভাবে দক্ষিণ সিটির নতুন ওয়ার্ডে এখনো মশক নিধন কাজ শুরু হয়নি।
গবেষণার তথ্য অনুযায়ী দেশব্যাপী সমন্বিত পরিকল্পনা ও কার্যক্রম পরিচালনার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগ, আইইডিসিআর, সিটি কর্পোরেশনসমূহ, স্থানীয় সরকার, রাজউকসহ অন্যান্য বিভাগীয় উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, ওয়াসা, রিহ্যাব, পরিবেশ অধিদপ্তর, গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, আবহাওয়া অধিদপ্তর ইত্যাদি দপ্তরগুলোর মধ্যে যে সমন্বয় প্রয়োজন তার ঘাটতি রয়েছে। অন্যদিকে যাদের ওপর মশা নিয়ন্ত্রণের মূল দায়িত্ব ছিল তাদের মধ্যে সমন্বয়ের ঘাটতি ও অবহেলার কারণে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ার পর কার্যকর পদক্ষেপের ঘাটতির পাশাপাশি সাধারণ জনগণের ওপর দায়চাপানোর প্রবণতা ও জরিমানা করার দৃষ্টান্ত লক্ষ্যণীয়। ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ও হটস্পট চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, সিটি কর্পোরেশন, সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের মধ্যে সমন্বয়ের ঘাটতি বিদ্যমান। এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ ও নিধনের ক্ষেত্রে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের নেতৃত্ব কখনোই সমিন্বতভাবে পরিকল্পনা করে নি এবং সমন্বিতভাবে মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের উদ্যোগ নেয়নি। কীটতত্ত্ববিদসহ অন্যান্য বিশেষজ্ঞদের শুধুমাত্র জরুরি পরিস্থিতিতে মতামতের জন্য ডাকা; জরুরি পরিস্থিতিতে যে কমিটিগুলো করা হয় তা পরবর্তীতে কার্যকর না থাকা; বিশেষজ্ঞদের মতামত পছন্দ না হলে তাদের পরবর্তীতে আর ডাকা হয়না বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া, উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইং ও আইইডিসিআর কর্তৃক কীটনাশকের নিবন্ধন প্রক্রিয়ার বিভিন্ন ধাপে ও কীটনাশকের কার্যকরতা পরীক্ষায় অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ থাকলেও এ বিষয়ে কোনো জবাবদিহিতার মুখোমুখি হতে দেখা যায় না।
সংবাদ সম্মেলনে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “ডেঙ্গু সমস্যা বাংলাদেশের জন্য নতুন কোনো সমস্যা ছিলো না। পর্যাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণসহ সতর্কীকরণ সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অস্বীকৃতির মানসকিতা, প্রস্তুতি ও কৌশলের অভাব এবং যথাযথ গুরুত্ব না দিয়ে এড-হকভিত্তিতে কার্যক্রম পরিচালিত হওয়ায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। সুনির্দিষ্ট কৌশলের অভাবে এডিস মশার নিয়ন্ত্রণে কোনো সমন্বিত পরিকল্পনা গুরুত্ব পায়নি। তুলনামূলকভাবে অকার্যকর রাসায়নিক ব্যবহারসহ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণমূলক ও অ্যাডাল্টিসাইট নির্ভর কিছু কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়।”
সংশ্লিষ্ট অংশীজনের মধ্যে সমন্বয় ও তথ্য আদান-প্রদানের ঘাটতির কথা উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, “কীটনাশক ক্রয়ের প্রতিটি ধাপে ধাপে দুর্নীতি হয়েছে। ক্রয় বিধিমালা অনুসরণ না করে, যোগ্যতার শর্তাবলি পূরণ না করে, কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে এমন সংস্থাকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। বিল অনুমোদন, বিল প্রদান, পণ্য সরবরাহসহ সকল পর্যায়ে অবৈধ লেনদেন হয়েছে। ফলে রাষ্ট্রীয় অর্থের ব্যাপক অপচয় হয়েছে। একটি ক্ষেত্রে ক্রয়মূল্যের আনুমানিক ৪০ শতাংশ ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে অতিরিক্ত ব্যয় করা হয়েছে। ডেঙ্গু যেহেতু দীর্ঘদিনের সমস্যা যা স্বল্পমেয়াদে সমাধান সম্ভব নয়, সেই কারণে একটি জাতীয় কৌশল প্রণয়নের আহ্বান জানাচ্ছি। এক্ষেত্রে, সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সম্পৃক্ত করে স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। এছাড়া, বাজেটের ঘাটতি ছিলো বলে আমাদের কাছে মনে হয়নি। পর্যাপ্ত অর্থ বাজেট থেকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, প্রয়োজন থাকলে হয়তো আরো দেওয়া হতো, কিন্তু সেটার ব্যবহার করার ক্ষেত্রে যে একদিকে অনিয়ম ও অন্যদিকে দক্ষতার ঘাটতি ছিলো আমরা তা চিহ্নিত করেছি। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে ক্রয় প্রক্রিয়ার অনিয়মের সাথে জড়িতদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা সম্ভব। যার মাধ্যমে এই ধরনের সমস্যা সমাধানে ইতিবাচক অগ্রগতি সম্ভব বলে আমরা মনে করি।”
গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে টিআইবির পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিবেচনার জন্য পনের দফা সুপারিশ পেশ করা হয়েছে। উল্লেখযোগ্য সুপারিশসমূহ: সংশ্লিষ্ট সকল অংশীজনদের সমন্বয়ে জাতীয় পর্যায়ে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনা কৌশল ও কর্ম-পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে, যেখানে সকল অংশীজনের দায়িত্ব ও কর্তব্য সুস্পষ্ট করতে হবে; জাতীয় কৌশল ও কর্মপরিকল্পনার সাথে সামঞ্জস্য রেখে সংশ্লিষ্ট অংশীজনকে মশা নিধনে নিজস্ব পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে; এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে সকল প্রকার পদ্ধতির ব্যবহার নিশ্চিত করে সিটি কর্পোরেশনগুলোকে সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে; পরিবেশবান্ধব পদ্ধতির ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে (যেমন, এডিস মশার উৎস নির্মূল, পরিবেশবান্ধব রাসায়নিক ব্যবহার); বছরব্যাপী এ কার্যক্রম পরিচালনার পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে; এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে নির্মাণাধীন ভবন, নির্মাণ প্রকল্প ইত্যাদি বিষয় সংশ্লিষ্ট সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের (রিহ্যাব, হাউজিং এস্টেট কোম্পানি ইত্যাদি) দায়িত্ব ও কর্তব্য কী হবে তা সংশ্লিষ্ট আইনগুলোতে স্পষ্ট করতে হবে। দায়িত্ব ও কর্তব্যের ব্যত্যয়ের ক্ষেত্রে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার বিধান থাকতে হবে; স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে সকল সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল ও রোগ-নির্ণয় কেন্দ্রকে একটি কেন্দ্রীয় ডাটাবেজের অধীনে নিয়ে আসতে হবে, যেখানে সকলের প্রবেশের সুযোগ থাকবে; ডেঙ্গু রোগী চিহ্নিত হওয়ার সাথে সাথে সিটি কর্পোরেশন এবং দেশের অন্য এলাকায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করতে হবে; স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, আইইডিসিআর ইত্যাদি দপ্তরের সহযোগিতা নিয়ে প্রতিবছর ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাবের শুরুতেই সিটি কর্পোরেশনগুলো সব হটস্পট চিহ্নিত করবে এবং এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের ব্যবস্থা করবে; এডিস মশার জরিপ কার্যক্রম ঢাকার বাইরে সম্প্রসারিত করতে হবে; এক্ষেত্রে স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়, কীটতত্ত্ববিদ, বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের সহায়তা নেওয়া যেতে পারে; জনসংখ্যা, আয়তন, ডেঙ্গু আক্রান্তের হার, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা ইত্যাদি বিবেচনা করে মাঠ পর্যায়ের জনবলের চাহিদা নিরূপণ ও এবং চাহিদার ভিত্তিতে নিয়োগ, আউট সোর্সিং বা জনসম্পৃক্ততা নিশ্চিত করে স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন করতে হবে; এর জন্য পর্যাপ্ত ও সুষম বাজেট বরাদ্দ দিতে হবে; মশা নিধন কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবক দলকে এডিস মশা নির্মূলের জন্য যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে; উপযুক্ত কীটনাশক ও এর চাহিদা নির্ধারণ, ক্রয়, কার্যকরতা ও সহনশীলতা পরীক্ষার জন্য সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে বিশেষজ্ঞ কারিগরি কমিটি করতে হবে; তাদের কার্যক্রম নিয়মিত হতে হবে এবং সভাগুলোর কার্যবিবরণী প্রকাশ করতে হবে; অনিয়ম-দুর্নীতি প্রতিরোধে কীটনাশক ক্রয় প্রক্রিয়ায় জাতীয় ক্রয় আইন ও বিধিমালা অনুসরণ করতে হবে; মশা নিধন কার্যক্রম-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম-দুর্নীতি ও দায়িত্বে অবহেলার বিষয়গুলো তদন্ত করে সংশ্লিষ্টদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে; মশার কীটনাশক প্রতিরোধী ক্ষমতা রোধ করার জন্য কিছুদিন পরপর যথাযথ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে কীটনাশক পরিবর্তন, একেক এলাকায় ভিন্ন ভিন্ন কীটনাশক ব্যবহার ইত্যাদি নিশ্চিত করতে হবে; তৃতীয় পক্ষ (বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, কীটতত্ত্ববিদ, বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ইত্যাদি) কর্তৃক মশার কীটনাশক প্রতিরোধী ক্ষমতা এবং মশা নিধন কার্যক্রম মনিটরিং এর ব্যবস্থা করতে হবে; আইইডিসিআর, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইংয়ের কীটতত্ত্ববিদসহ বিশেষজ্ঞ শূন্যপদগুলো পূরণ করতে হবে এবং পদ না থাকলে পদ সৃষ্টি করতে হবে।
উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের ২০ আগস্ট থেকে ২০ সেপ্টেম্বর সময়কালের মধ্যে এ গবেষণার তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ ও প্রতিবেদন প্রণয়নের কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। যেখানে তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে গত পাঁচ বছরের মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমকে বিবেচনা করা হয়েছে। গবেষণাটি পরিচালনার ক্ষেত্রে গুণগত গবেষণা পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উভয় উৎস হতে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রত্যক্ষ তথ্যের উৎস হিসেবে উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন, উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইং, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, মশক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, কীটনাশক আমদানি, বিক্রয় ও উৎপাদন প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি বালাই/কীট নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠান। এবং পরোক্ষ তথ্যের উৎস হিসেবে প্রাসঙ্গিক আইন ও বিধি, গবেষণা প্রতিবেদন, ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য, বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করা হয়েছে। প্রত্যক্ষ তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতি হিসেবে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী, কীটতত্ত্ববিদ, জনস্বাস্থ্য গবেষক, কীটনাশক আমদানিকারক, বিক্রয় ও উৎপাদনকারী, বেসরকারি বালাই/কীট নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠানের মালিকদের মুখ্য তথ্যদাতা হিসেবে সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়েছে।
গণমাধ্যম যোগাযোগ,
শেখ মন্জুর-ই-আলম
পরিচালক (আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন)
মোবাইল: ০১৭০৮৪৯৫৩৯৫
ই-মেইল: manjur@ti-bangladesh.org