সংবাদ বিজ্ঞপ্তি
বুড়িমারী স্থলবন্দর ও শুল্ক স্টেশন এবং মোংলা বন্দর ও কাস্টমস হাউসে পণ্য ছাড় ও শুল্কায়নের প্রায় শতভাগ ক্ষেত্রেই নিয়মবহির্ভূত আর্থিক লেনদেন হয়: টিআইবি’র গবেষণা
ঢাকা, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮: বুড়িমারী স্থলবন্দর ও শুল্ক স্টেশন এবং মোংলা বন্দর ও কাস্টমস হাউস উভয় প্রতিষ্ঠানেই পণ্য ছাড় ও শুল্কায়নের প্রায় শতভাগ ক্ষেত্রেই নিয়মবহির্ভূত আর্থিক লেনদেন হয়। পণ্য ছাড় ও শুল্কায়নের ক্ষেত্রে বিদ্যমান দীর্ঘ ও জটিল প্রক্রিয়া; সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের একাংশ এবং শ্রমিক, দালাল ও নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের একাংশের যোগসাজশে গড়ে ওঠা অসৎ চক্র; দুর্নীতির বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত শাস্তিমূলক ব্যবস্থার ঘাটতি এবং পুরোপুরি ডিজিটাল প্রক্রিয়ায় সেবা প্রদান ব্যবস্থার অনুপস্থিতিতে এসব প্রতিষ্ঠানে অনিয়ম-দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ ঘটছে এবং এসব অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে রাজনৈতিক সদিচ্ছার ঘাটতি রয়েছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) পরিচালিত ‘মোংলা বন্দর ও কাস্টমস হাউজ এবং বুড়িমারী স্থলবন্দর ও শুল্ক স্টেশন: আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়ায় সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক এক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। গবিষণাটির প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আজ টিআইবি’র ধানমন্ডিস্থ কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্নীতি প্রতিরোধ, সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও কর্ম-দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে পণ্যের শুল্কায়ন, পণ্য-ছাড় এবং জাহাজের আগমন-বহির্গমন প্রক্রিয়ায় কার্যকর ওয়ান স্টপ সার্ভিস প্রদান নিশ্চিতে সকল পর্যায়ে অটোমেশন চালু করার সুপারিশসহ আট দফা সুপারিশ পেশ করেছে টিআইবি। টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান এবং আউটরিচ ও কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক শেখ মনজুর-ই-আলম সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন টিআইবি’র গবেষণা ও পলিসি বিভাগের প্রোগ্রাম ম্যানেজার মনজুর ই খোদা ও ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার মো. খোরশেদ আলম।
মোংলা ও বুড়িমারী বন্দর এবং সংশ্লিষ্ট কাস্টম হাউজের মাধ্যমে পণ্য আমদানি রপ্তানি প্রক্রিয়ায় বিদ্যমান সুশাসনের চ্যালেঞ্জ পর্যালোচনাসহ চ্যালেঞ্জসমূহ উত্তরণে প্রয়োজনীয় সুপারিশ প্রণয়নের উদ্দেশ্যে এ গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে। জুলাই ২০১৭ থেকে সেপ্টেম্বর ২০১৮ সময়ে পরিচালিত এ গুণগত গবেষণায় বন্দর ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারী, সিএন্ডএফ এজেন্ট, শিপিং এজেন্ট, স্টিভিডোর, ক্যারিয়ার, সাংবাদিক, ব্যবসায়িক নেতৃবৃন্দ, শ্রমিক ও অন্যান্য অংশীজন থেকে প্রত্যক্ষ তথ্য সংগ্রহীত হয়েছে। অন্যদিকে, সংশ্লিষ্ট বন্দর ও কাস্টমস হাউস সংক্রান্ত বিভিন্ন দাপ্তরিক দলিল, প্রবন্ধ, সাময়িকী, ওয়েবসাইট এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রকাশনা থেকে গবেষণার পরোক্ষ তথ্য সংগৃহীত হয়েছে।
গবেষণায় দেখা যায়, ২০১০ সালে বুড়িমারী বন্দর কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা এবং বন্দরের অবকাঠামোগত উন্নয়নের ফলে পণ্যের শুল্কায়ন ছাড়াই স্পট রিলিজ বা পণ্য ভর্তি ট্রাক পাচার, একই বিল অব এন্ট্রির বিপরীতে একাধিক পণ্যের চালান পাচারের মাধ্যমে শুল্ক ফাঁকি সংক্রান্ত অনিয়ম বন্ধ হয়েছে। বুড়িমারী বন্দর দিয়ে ১৮টি বাণিজ্যিক পণ্যের আমদানি নিষিদ্ধ হওয়ার কারণে মিস ডিক্লারেশন এবং ওভার-আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে শুল্ক ফাঁকির অভিযোগ কমে এসেছে। উভয় কাস্টমসের সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড ব্যবহার হচ্ছে। ফলে সকল কাস্টমস হাউসের মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমে ওভার-আন্ডার ইনভয়েসিং এর মাধ্যমে শুল্ক ফাঁকি কমার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। তবে এখনো পেপারলেস অফিস প্রতিষ্ঠিত হয়নি এবং বিদ্যমান ওয়ান স্টপ সার্ভিস অকার্যকর। উভয় বন্দরে পণ্যছাড়ের ক্ষেত্রে অটোমেশন অনুপস্থিত। উভয় বন্দর ও কাস্টমস হাউসের সেবা প্রদানে প্রায় শতভাগ ক্ষেত্রেই নিয়মবহির্ভূত অর্থ আদায়সহ রাজস্ব ফাঁকির ঘটনা ঘটছে। সুশাসনের জন্য প্রয়োজনীয় কাঠামো ব্যবস্থা উপস্থিত থাকলেও তার কার্যকরতায় ঘাটতি রয়েছে। সার্বিকভাবে দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানীকরণ ঘটছে, যা নিয়ন্ত্রণে রাজনৈতিক সদিচ্ছার ঘাটতি রয়েছে।
গবেষণা প্রতিবেদনে অনুযায়ী, ২০১৬-২০১৭ সালে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে প্রাক্কলনে সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে মোংলা সমুদ্র বন্দর থেকে কমপক্ষে ৪ কোটি ৬১ লাখ টাকা এবং মোংলা কাস্টমস হাউস থেকে কমপক্ষে ১৫ কোটি ৬৯ লাখ টাকা নিয়মবহির্ভূতভাবে আদায় করা হয়েছে বলে ধারণা করা যেতে পারে। অনুরূপভাবে, সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে বুড়িমারী শুল্ক স্টেশনে দুই কোটি ৮৫ লাখ টাকা এবং বুড়িমারী স্থল বন্দরে ৪৮ লাখ টাকা নিয়মবহির্ভূতভাবে আদায় করা হয়েছে বলে ধারণা করা যায়। আমদানিকৃত প্রায় শতভাগ পণ্যের ক্ষেত্রে বিওই-প্রতি নিয়মবহির্ভূত অর্থ আদায় করেছে উভয় প্রতিষ্ঠান। সকল নথিপত্র নির্ভুল থাকা সত্ত্বেও একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ না দিয়ে পণ্যের শুল্কায়ন বা পণ্যছাড় সম্ভব হয় না। নথিপত্রে কোন ভুল থাকলে অথবা শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার ক্ষেত্রে নিয়মবহির্ভূত অর্থের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। বন্দরে পণ্য ছাড় ও শুল্কায়নের ক্ষেত্রে অবৈধ অর্থ প্রদান ছাড়াও সংশ্লিষ্ট আরও কিছু ক্ষেত্রেও পণ্য আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে অবৈধ অর্থ প্রদান করতে হয়। যেমন, মোটর শ্রমিক ইউনিয়ন ট্রাক-প্রতি ন্যূনতম ৯০০ টাকা চাঁদা হিসেবে আদায় করে থাকে। দালালের সাহায্য ছাড়া বুড়িমারী স্থল বন্দরে ট্রাক ভাড়া পাওয়া যায় না বিধায় ট্রাক-প্রতি দালালকে প্রায় ৪০০ টাকা ঘুষ দিতে হয়। মোটর শ্রমিক ইউনিয়ন কর্তৃক বছরে প্রায় ৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করা হয় বলে গবেষণায় প্রাক্কলিত হয়েছে।
গবেষণায় দেখা যায়, মোংলা কাস্টমস হাউসে আমদানি পণ্যের ক্ষেত্রে ন্যূনতম ১৬টি এবং রপ্তানি পণ্যের ক্ষেত্রে ১২টি ধাপে নথি যাচাই-বাছাই ও অনুমোদন সম্পন্ন হয় যার ফলে সময়ক্ষেপণ, দীর্ঘসূত্রতা, হয়রানি ও দুর্নীতির ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। আবার আমদানি পণ্যের শতভাগ কায়িক পরীক্ষণের ক্ষেত্রে সময়ক্ষেপণ, হয়রানিসহ পণ্যের মান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমদানি-রপ্তানি পণ্যবাহী জাহাজ আগমন-নির্গমনে বিভিন্ন অনুমোদন ও মাশুল আদায় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে শুধু কাস্টমস হাউসে ন্যূনতম ৮টি ধাপ অতিক্রম করতে হয়।
মোংলা বন্দর সম্পর্কিত গবেষণা ফলফলে দেখা যায়, আমদানি পণ্যের ক্ষেত্রে ন্যূনতম ১৮টি এবং রপ্তানি পণ্যের ক্ষেত্রে ১২টি ধাপে নথি যাচাই-বাছাই ও অনুমোদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। আবার পণ্যবাহী জাহাজ আগমন-বহির্গমনে বিভিন্ন অনুমোদন ও মাশুল আদায়ে শুধুমাত্র বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ন্যূনতম ৬টি ধাপে অনুমোদন গ্রহণ প্রক্রিয়ার উপস্থিতিতে সময়ক্ষেপণ, দীর্ঘসূত্রতা, হয়রানি ও দুর্নীতির ঝুঁকি বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির অনুমোদিত জনবলের ৫৯% পদ শূন্য রয়েছে। জনবল নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক চাপ বা প্রভাবের উপস্থিতি গবেষণায় পাওয়া গেছে। স্মার্ট বয়া, লাইটেড বয়া, লাইটহাউস টাওয়ারের ঘাটতি ও যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাব, জাহাজের নাইট নেভিগেশনে বন্ধ প্রভৃতির কারণে টার্ন এরাউন্ড টাইম, খরচ ও ঝুঁকি বৃদ্ধি পেয়েছে। বন্দরে বিশেষায়িত কার শেড না থাকায় পাটের গুদামে বা ওপেন ইয়ার্ডে গাড়ি রাখা হয়।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন,“উভয় বন্দরেই ইতিবাচক কিছু অগ্রগতি ও পরিবর্তন হয়েছে যা সুশাসনের ঘাটতি সামান্য হলেও উন্নতির সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য পদক্ষেপ ও পদ্ধতির উপস্থিতির বিষটিও ইতিবাচক। কিন্তু এসব ইতবাচক অগ্রগতি ও সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও উভয় বন্দরেই যোগসাজশের দুর্নীতি ও বলপূর্বক ঘুষ আদায়ের দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ গ্রহণ করেছে।” সেবা প্রদান প্রক্রিয়া যত দীর্ঘ ও জটিল হয় সেবাগ্রহীতাদের দুর্নীতির শিকার হওয়ার ঝুঁকি তত বৃদ্ধি পায় উল্লেখ করে ড. জামান বলেন, “সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে সেবার আধুনিকায়ন, ডিজিটাইজেশন ও তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সেবাগ্রহীতার সাথে সেবা প্রদানকারীর প্রত্যক্ষ যোগাযোগের বাধ্যবাধকতা কমিয়ে আনতে পারলে দুর্নীতির সম্ভাবনা ও সুযোগ কমে যায়।” দুর্নীতি প্রতিরোধের ক্ষেত্রে সেবার ডিজিটাইজেশন অত্যন্ত বড় একটি সমাধান উল্লেখ করে ড. জামান দুর্নীতি প্রতিরোধ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় নিয়োজিত সকল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে সেবা খাতে ডিজিটাইজেশন পদ্ধতি প্রচলনের লক্ষ্যে জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান।
সংবাদ সম্মেলনে টিআইবি’র পক্ষ থেকে শুল্কায়ন দ্রুত ও সহজতর করতে মোংলা বন্দর এলাকায় কাস্টমস হাউসের পূর্ণাঙ্গ কার্যালয় স্থাপন এবং প্রযুক্তির ব্যবহারকে প্রাধান্য দিয়ে পণ্যের শতভাগ কায়িক পরীক্ষণের পরিবর্তে দৈবচয়নের ভিত্তিতে আংশিক (১০%-২০%) পণ্যের কায়িক পরীক্ষণ করার সুপারিশ করে টিআইবি। আট দফা সুপারিশের অপর উল্লেখযোগ্য সুপারিশসমূহ হলো: প্রয়োজনীয়তা পর্যালোচনা সাপেক্ষে বিভিন্ন স্তরে শূন্য পদের বিপরীতে নতুন জনবল নিয়োগ করা; প্রতি বছর সকল পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীর আয় ও সম্পদের বিবরণী প্রকাশ করা; বৈধ আয়ের সাথে সম্পদের অসামঞ্জস্যতার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আইনি প্রক্রিয়ায় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা; নিয়মবহির্ভূতভাবে অর্থ লেনদেন বন্ধে বন্দর ও কাস্টমসের সম্পূর্ণ এলাকা সার্বক্ষণিকভাবে সিসি ক্যামেরার আওতায় আনা ও দৃশ্যমান স্থানে মনিটর স্থাপন করা; এবং সকল প্রকার মাশুল ও শুল্ক অনলাইনে এবং ব্যাংকের মাধ্যমে গ্রহণ নিশ্চিত করা।
গণমাধ্যম যোগাযোগ,
শেখ মনজুর-ই-আলম
পরিচালক, আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগ
মোবাইল: ০১৭০৮৪৯৫৩৯৫
ই-মেইল: manjur@ti-bangladesh.org