সংবাদ বিজ্ঞপ্তি
সংশ্লিষ্টতা না থাকলেও অনেক ক্ষেত্রেই নারীকে পুরুষের দুর্নীতির দায় নিতে হয়
দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অবৈধ আয় ও সম্পদের দায় থেকে নারীদের সুরক্ষায় সচেতনতা বৃদ্ধি ও অপরাধীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার বিকল্প নেই
ঢাকা, ৬ মে ২০১৮: দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ ও সম্পদ রক্ষার্থে বা আইনকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করা হয়। অর্জিত সম্পত্তি নিজের নামে না রেখে পরিবারের অন্য সদস্য বিশেষকরে স্ত্রীর নামে রাখা এমনই একটি পন্থা। অনেক ক্ষেত্রে স্ত্রী এ বিষয়ে জানেন না, আবার অনেক ক্ষেত্রে স্ত্রী এ সম্পর্কে জানেন ও তার সম্মতি থাকে। এ ধরণের প্রবণতার ফলে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অবৈধ আয় ও সম্পদের পারিবারিক দায় নারীর ওপর বর্তায় এবং নারীকে উক্ত অবৈধ আয় ও সম্পদের হিসাব দেওয়ার জন্য দায়বদ্ধ বা অপরাধী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। দুর্নীতির অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে নারীদের দুর্নীতির শিকার, দুর্নীতির সংঘটক, দুর্নীতির মাধ্যম এবং দুর্নীতির সুবিধাভোগীসহ বিভিন্ন ভূমিকায় দেখা যায়। আজ সকালে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)’র ধানমন্ডিস্থ কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ‘দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত আয় ও সম্পদের পারিবারিক দায়: নারীর ভূমিকা, ঝুঁকি ও করণীয়’ শীর্ষক এক মতবিনিময় সভায় এসব পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা হয়। টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত এ মতবিনিময় সভায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এর চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। এছাড়াও টিআইবি’র উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান, সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সাংবাদিকগণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। সভায় সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কার্যপত্র উপস্থাপন করেন টিআইবি’র গবেষণা ও পলিসি বিভাগের প্রোগ্রাম ম্যানেজার শাম্মী লায়লা ইসলাম।
মতবিনিময় সভায় বক্তারা বলেন, দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ আয় ও সম্পদ অর্জনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর কোনোরূপ সংশ্লিষ্টতা না থাকা সত্ত্বেও নারীকে অপরাধের দায় নিতে হয়। এক্ষেত্রে পুরুষতান্ত্রিক আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট, নারীর অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা, পরিবারের প্রতি নারীর সহমর্মী মনোভাব, দুর্নীতিপরায়ণ মানসিকতা ইত্যাদি এ ঝুঁকি বিস্তারে নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। এ ঝুঁকি মোকাবেলায় নারীর সজাগ ও সচেতন কার্যকরতা এ ধরণের অপরাধ দমন ও প্রতিরোধে অর্থপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। পাশাপাশি, সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীর অধিকতর অন্তর্ভুক্তি, পারিবারিক ও সামাজিকভাবে প্রচলিত ক্ষমতা-কাঠামোতে পুরুষতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার পরিবর্তন, দুর্নীতির দৃষ্টান্তমূলক ও কার্যকর দমন ও প্রতিরোধ এবং উল্লিখিত পরিবর্তনসমূহ প্রচলনে রাষ্ট্র ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের সদিচ্ছা সার্বিকভাবে এ ঝুঁকি হ্রাসে সহায়ক হবে।
সভায় উপস্থাপিত কার্যপত্র অনুযায়ী, ২০০৭ থেকে মার্চ, ২০১৮ পর্যন্ত দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কর্তৃক দায়েরকৃত ২৯টি মামলায় অধস্তন বিচারিক আদালত স্বামীর দুর্নীতির কাজে সহায়তা বা জ্ঞাত আয়-বহির্ভূত সম্পদ অর্জন বা সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে ২৯ জন নারীকে কারাদ- বা আর্থিক জরিমানা বা উভয় দ- প্রদান করেছেন। ২০১৫-২০১৭ সাল পর্যন্ত দুদকে স্বামী কর্তৃক অবৈধ আয় করে স্ত্রীর নামে সম্পদ অর্জন সংক্রান্ত ১১৮টি অভিযোগ অনুসন্ধানের পর্যায়ে রয়েছে একং এ সংক্রান্ত ৩০টি মামলা তদন্তাধীন এবং ১৪টি মামলায় চার্জশীট প্রদান করা হয়েছে।
মতবিনিময় সভার কার্যপত্রের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, দরিদ্রদের মধ্যে দরিদ্রতর হিসেবে নারীর ওপর দুর্নীতির নেতিবাচক প্রভাব অনেক বেশি বলে ধারণা করা হয়। বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুদক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান স্বামীর অবৈধ সম্পদ বা আয়ের উৎস স্ত্রীর কাছে জানতে চাইলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্ত্রী সঠিকভাবে জবাব দিতে ব্যর্থ হন এবং আইনি প্রক্রিয়ার সম্মুখীন হন। অনেক সময় দেখা যায় স্ত্রীকে রক্ষা করার বদলে স্বামী নিজেকে বাঁচাতে দাবি করেন যে স্ত্রীর সম্পদের হিসাব তিনি জানেন না। অনেক ক্ষেত্রে স্বামীকে বাঁচাতে বা উক্ত সম্পদ বাজেয়াপ্ত হওয়া থেকে রক্ষা করতে স্ত্রী নিজে দায় স্বীকার করেন। আবার স্ত্রী যদি অস্বীকারও করেন যে তিনি তার নামে রাখা সম্পদ সম্পর্কে কিছু জানেন না, তারপরও তিনি অবৈধ সম্পদ রাখার সহযোগী হিসেবে মামলার আসামী হয়ে যান। এই প্রবণতার ফলে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অবৈধ আয় ও সম্পদের পারিবারিক দায় নারীর ওপর বর্তায় এবং নারীকে উক্ত অবৈধ আয় ও সম্পদের হিসাব দেওয়ার জন্য দায়বদ্ধ বা অপরাধী হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
সভায় বক্তারা বলেন, নারীর ওপর এ সংক্রান্ত বহুমুখী ঝুঁকি মোকাবেলায় নারীকে এ বিষয়ে সচেতন করে তুলতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ব্যাপক প্রচারণামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। এ প্রচারণা কার্যক্রমে সমাজের বিভিন্ন ধ্যান-ধারণার পরিবর্তনে ঝুঁকির পাশাপাশি ইতিবাচক বিষয়সমূহ তুলে ধরতে হবে। এ সংক্রান্ত বিদ্যমান আইনসমূহ সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। এছাড়া নারী অধিকার সংগঠন কর্তৃক দুর্নীতির শিকার নারীকে আইনগত সহায়তা প্রদানের উদ্যোগ নিতে হবে। নারীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অনুসন্ধান, তদন্ত ও মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন কমিশনকে সংবেদনশীল হতে হবে এবং আরও নারী-বান্ধব ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
দুদক-এর বিভিন্ন মামলার পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে দুদক এর চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, ‘‘দুর্নীতিগ্রস্ত মানষিকতা ছাড়াও অনেক ক্ষেত্রে নারী শুধু সচেতনতার অভাবে বা দুর্নীতিমনষ্ক পারিবারিক প্রধানের নানাবিধ অনৈতিক চাপে না জেনেই এ অপরাধের অংশীদার হয়ে যাচ্ছেন। আবার দুর্নীতির বিষয়টি বুঝলেও পারিবারিক সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীর সীমিত ক্ষমতা, প্রতিবাদে বা বিরুদ্ধাচরণে নারীর সামাজিক বাধা-বিপত্তি, প্রতিবাদের অপর্যাপ্ত স্বাধীনতার ফলে বেশিরভাগ নারীই এ অন্যায়ের বিরুদ্ধ রুখে দাঁড়াতে পারছেন না। সংশ্লিষ্ট আইন ও সহায়ক প্রতিষ্ঠানের আইনী সুরক্ষার বিষয়েও তারা অবগত না, যা নারীকে এক ভয়াবহ ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। এ ঝুঁকি মোকাবেলা ও সার্বিকভাবে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিতে নারীর ক্ষমতায়ন, সিদ্ধান্ত-গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অধিকতর অন্তর্ভুক্তি, বিষয়-ভিত্তিক সচেতনতা, গণমাধ্যমে প্রচারণা, বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা-বিতর্ক অব্যাহত রাখতে হবে। নারীর এ ঝুঁকি নিরসনে দুদক সক্রিয় রয়েছে এবং সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠানসমূহসহ সকলকে এ বিষয়ে সচেতনতা গড়ে তুলতে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।”
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত আয় ও সম্পদের পারিবারিক ও ব্যক্তিগত দায় সম্পর্কে নারীদেরকে সজাগ ও সচেতন করার উদ্দেশ্যে প্রচারণা চালাতে হবে এবং এর মাধ্যমে আইনি বাধ্যবাধকতা ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের শাস্তি সম্পর্কে নারীদের জানাতে হবে। এছাড়া পরিবারের সুরক্ষায় পুরুষের দুর্নীতি সম্পর্কে নারীকে সোচ্চার ও সচেতন হবার কোন বিকল্প নেই। তবে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত আয় ও সম্পদের যে দায় নারীকে বহন করতে হচ্ছে তার সাথে নারীরা কতটুকু সজ্ঞানে জড়িত তা নিরূপণে আরও গবেষণা ও নীতি-কাঠামো সুনির্দিষ্ট করা প্রয়োজন। নারীর ক্ষমতায়নে অগ্রগতি অর্জন সম্ভব হলে তা সার্বিকভাবে দুর্নীতি প্রতিরোধ ও দমনে খুবই সহায়ক হবে।”
মতবিনিময় সভায় আরো অংশগ্রহণ করেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল; মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন এর নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম; এ্যাকশন এইড বাংলাদেশ এর দেশীয় পরিচালক ফারাহ কবির; বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ এর নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া কবির; নিজেরা করি এর সমন্বয়ক খুুশি কবির; দুদক এর মহাপরিচালক (তদন্ত) মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান, ও মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) জনাব মাহমুদ হাসানসহ বিভিন্ন সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ ও গণমাধ্যমের প্রতিনিধিবৃন্দ।বক্তব্য প্রদান পর্ব শেষে প্রশ্নোত্তর পর্বে গণমাধ্যমকর্মীদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ ও টিআইব’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। সমাপনী বক্তব্যে সভায় অংশগ্রহণের জন্য সকলকে ধন্যবাদ জানিয়ে বক্তব্য রাখেন টিআইবি’র উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের।
উল্লেখ্য, নারীর ওপর দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অবৈধ আয় ও সম্পদের পারিবারিক দায়ের ঝুঁকির বিশ্লেষণ, এই প্রক্রিয়ায় নারীর ভূমিকা, সংশ্লিষ্ট আইনি, প্রাতিষ্ঠানিক ও আর্থ-সামাজিক কাঠামোগত প্রভাব চিহ্নিত করা এবং এর প্রেক্ষিতে করণীয় নির্ধারণে সহায়ক আলোচনার সুযোগ সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে টিআইবি’র উদ্যোগে এ মতবিনিময় সভাটি আয়োজন করা হয়।
গণমাধ্যম যোগাযোগ,
মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম
সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার, আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগ
মোবাইল: ০১৭১৪০৯২৮৬৪
ই-মেইল:zahid@ti-bangladesh.org