সংবাদ বিজ্ঞপ্তি
সেবাখাতে দুর্নীতি হ্রাস ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর তথ্য-প্রযুক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধিতে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের ভূমিকা ব্যাপক সম্ভাবনাময়
ইউডিসি পরিচালনা ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য টিআইবি’র ১১ দফা সুপারিশ
ঢাকা, ৩ ডিসেম্বর ২০১৭: ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর এক গবেষণায় তৃণমূল পর্যায়ে জনগণের কাছে সরকারি, বাণিজ্যিক ও তথ্য সেবা ডিজিটাল পদ্ধতিতে দ্রুত ও সহজলভ্য করতে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার (ইউডিসি) একটি ব্যাপক সম্ভাবনাময় উদ্যোগ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। গবেষণার আওতাভুক্ত গ্রামাঞ্চলের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ খানা ২০১৬ সালে ইউডিসি থেকে বিভিন্ন ধরনের সেবা গ্রহণ করেছে এবং এসকল সেবাগ্রহীতাদের ৬০.৭% সার্বিকভাবে ইউডিসি’র সেবায় সন্তুষ্ট বলে জানিয়েছে। ২০১৩-১০১৫ সালে ৪ কোটি ৫০ লাখ সেবাগ্রহীতা ইউডিসি থেকে সরাসরি সেবা গ্রহণ করেছে। ইউডিসিতে ডিজিটাল সেবা প্রচলনের পর জমির পর্চা উত্তোলনের আবেদন ও পাসপোর্টের আবেদন ফরম পূরণসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সেবাগ্রহীতা ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সাথে সরাসরি সংযোগ হ্রাস পাওয়ায় নিয়ম বহির্ভূত অর্থ লেনদেনের ঝুঁকি হ্রাস পেয়েছে। টিআইবি পরিচালিত ‘নাগরিক সেবায় ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার: ভূমিকা, সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক এ গবেষণাটির প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আজ সকালে টিআইবি’র ধানমন্ডিস্থ কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে স্বচ্ছ ও কার্যকরভাবে ইউডিসি পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার জন্য একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়নের সুপারিশসহ ১১ দফা সুপারিশ পেশ করে টিআইবি। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের এবং গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান, সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার মো. ওয়াহিদ আলম ও ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার মোহাম্মদ নূরে আলম। সংশ্লিষ্ট গবেষক দলের অন্যতম সদস্য টিআইবি’র গবেষণা ও পলিসি বিভাগের প্রোগ্রাম ম্যানেজার জুলিয়েট রোজেটি গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন।
স্থানীয় পর্যায়ে নাগরিক সেবা প্রদানে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের (ইউডিসি) সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ পর্যালোচনার উদ্দেশ্যে পরিচালিত এ গবেষণাটি জুন ২০১৬ থেকে আগস্ট ২০১৭ সময়ের মধ্যে পরিচালিত হয়। পরিমাণগত ও গুণগত এ মিশ্র পদ্ধতির গবেষণায় জাতীয়ভাবে প্রতিনিধিত্বশীল ৩,০৫৩টি খানা, ১০৫টি ইউডিসি’র উদ্যোক্তাসহ ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) সচিবের ওপর জরিপের মাধ্যমে পরিমাণগত তথ্য সংগ্রহীত হয়। অন্যদিকে সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যান, ইউএনও, এডিসি (জেনারেল), এসি (আইসিটি), ডিডিএলজি, প্রোগ্রামার, স্থানীয় সরকার বিভাগের কর্মকর্তা ও এটুআই প্রকল্পের কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকার ও দলীয় আলোচনার মাধ্যমে গুণগত তথ্য সংগৃহীত হয়।
গবেষণায় দেখা যায়, প্রয়োজনীয় সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ও প্রযুক্তিগত দক্ষতার অভাবে দেশের ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের (ইউডিসি) কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রযুক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং সেবাখাতে দুর্নীতি হ্রাস করতে ব্যাপক সম্ভাবনাময় এই প্রতিষ্ঠান অদক্ষ উদ্যোক্তা, অচল যন্ত্রপাতি, বিদ্যুৎ বিভ্রাট ও ইন্টারনেটের ধীর গতিসহ বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে মানসম্মত সেবা প্রদান করতে পারছে না। ইউডিসি’র উদ্যোক্তাদের নির্বাচন ও তাদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা, চুক্তির মেয়াদ, মুনাফা বণ্টন, সেবামূল্য, ইউপি থেকে সহায়তা পাওয়ার শর্তাবলি এবং তথ্য সংরক্ষণ ও তদারকির ক্ষেত্রে অংশীজনদের জন্য নির্দেশনাসহ প্রয়োজনীয় সুনির্দিষ্ট নীতিমালার অভাব ইউডিসি কার্যক্রমের টেকসইকরণের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ হিসেবে কাজ করছে। সংশ্লিষ্ট সরকারি পরিপত্রে ইউডিসি’র উদ্যোক্তা নির্বাচনে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নিয়মসহ এ সংক্রান্ত পুরো প্রক্রিয়ার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা না থাকায় উদ্যোক্তা নির্বাচনের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার ঘাটতি লক্ষণীয়।
অধিকাংশ ইউডিসিতে সিম মোডেমের মাধ্যমে ইন্টারনেট সংযোগ থাকায় ইন্টারনেটের ধীর গতির ফলে অনলাইন সেবা প্রদান বিলম্বিত হচ্ছে। গবেষণায় দেখা যায়, জরিপকৃত ইউডিসিগুলোর ৯৮ শতাংশে সিম মোডেম, ১৩ শতাংশে সরকারি অপটিক ফাইবার এবং ৫ শতাংশে বেসরকারি ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ রয়েছে। এছাড়া নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের অপর্যাপ্ততার কারণে যৌক্তিক সময়ের মধ্যে সেবাগ্রহীতাদের সেবা প্রদানে ইউডিসি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে। স্থানীয় পর্যায়ে ইউডিসি’র সেবা সম্পর্কে প্রচারণার ক্ষেত্রে ঘাটতি লক্ষ্য করা যায়। জরিপে অন্তর্ভুক্ত ৭৯.৬% খানা ইউডিসি’র নাম জানলেও সকল সেবা সম্পর্কে জানে না। ইউডিসিসমূহে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক যন্ত্রপাতি অচল থাকায় দ্রুত সেবা প্রদান সম্ভব হচ্ছে না। অচল যন্ত্রপাতি মেরামত বা নতুনভাবে ক্রয়ের মাধ্যমে প্রতিস্থাপন করার নির্দেশনার ঘাটতির কারণে জরিপকৃত ইউডিসিসমূহে কম্পিউটার, ল্যাপটপ, প্রিন্টার ও ক্যামেরাসহ ফটোকপি মেশিনের মতো একান্ত প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির ৩২%-৪২% অচল থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। তৃণমূল পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিদের একাংশের মধ্যে ইউডিসি’র বিকাশ ও টেকসইকরণে অনুঘটকের ভূমিকা পালনে দায়িত্ববোধের ঘাটতি লক্ষণীয়। এছাড়াও গবেষণায় বিভিন্ন ধরনের সেবা সমন্বিতভাবে প্রদানের ব্যবস্থা প্রবর্তনের ক্ষেত্রে সেবা প্রদানকারী সকল প্রতিষ্ঠানসমূহের সম্পূর্ণ ডিজিটাইজেশন না হওয়াকে অন্যতম চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
গবেষণায় দেখা যায়, কিছু ক্ষেত্রে ইউপি’র নেতৃত্বে পরিবর্তন এবং ইউপি সচিবের সাথে পারস্পরিক সমঝোতা বা সম্পর্কের ঘাটতির কারণে এসব উদ্যোক্তা চুক্তি নবায়ন না হওয়ার আশঙ্কা করছেন। এছাড়া উদ্যোক্তাদের সাথে স্বল্পমেয়াদী চুক্তি হওয়ায় দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগে তাদের অনাগ্রহ পরিলক্ষিত হয়। সেবামূল্য সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকায় একই সেবার জন্য এলাকাভেদে সেবামূল্যের তারতম্য থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। জরিপকৃত ইউডিসিসমূহে সরকারি সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে সরকারি ফি’র বিপরীতে ইউডিসি কর্তৃক সেবাগ্রহীতাদের কোনো রশিদ প্রদানের তথ্য গবেষণায় পাওয়া যায়নি। প্রতিটি ইউডিসিতে একজন নারী ও একজন পুরুষ উদ্যোক্তা নির্বাচনের বিধান থাকলেও স্থানীয়ভাবে যোগ্য নারী উদ্যোক্তার অভাব এবং নারী উদ্যোক্তার সংসারী হওয়ার কারণে জপিরকৃত ইউডিসিগুলোর ২৩% শুধু পুরুষ উদ্যোক্তা দিয়ে চলছে।
গবেষণা প্রতিবেদনে নাগরিক সেবায় ইউডিসি’র একাধিক সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সম্ভাবনাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: স্থানীয় পর্যায়ে সেবা সম্পর্কে প্রচারণা ও সেবার পরিধি বৃদ্ধির মাধ্যমে আয় ও মুনাফা বৃদ্ধি; প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণের সুযোগে স্থানীয় প্রান্তিক মানুষের আয় বৃদ্ধি; সকল প্রতিষ্ঠানের সেবাসমূহ সম্পূর্ণ ডিজিটাইজড করে বিভিন্ন সেবা সমন্বিতভাবে প্রদানের ব্যবস্থার প্রবর্তনের মাধ্যমে সেবার সহজীকরণের সুযোগ; এবং সেবাগ্রহীতাদের সাথে কেন্দ্রীয় ও জেলা পর্যায়ের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সরাসরি সংযোগ হ্রাস করে সেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে হয়রানি, অনিয়ম ও দুর্নীতির ঝুঁকি হ্রাস করা।
ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার (ইউডিসি) থেকে জমির পর্চা উত্তোলন বা পাসপোর্টের ফরম পূরণ সংক্রান্ত সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে সেবাগ্রহীতারা কোনো হয়রানির শিকার হননি, কিন্তু স্থানীয় সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে একই সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে সেবাগ্রহীতারা এখনো অতিরিক্ত অর্থ প্রদানসহ বিভিন্ন হয়রানির শিকার হচ্ছেন বলে উল্লেখ করে টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অভীষ্ট ১৬.৪ ও ১৬.৫ এ জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলো সকল পর্যায়ে ঘুষ লেনদেন উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে আনার পরিষ্কার অঙ্গীকার করেছে। আর ঘুষ লেনদেন হ্রাস করতে ডিজিটাল পদ্ধতি অন্যতম একটি উপায় বলে আন্তর্জাতিকভাবে বিশ^াস করা হয়। ইউডিসিগুলো তৃণমূল জনগণের কাছে সরকারি, বেসরকারি ও বাণিজ্যিক তথ্য ও সেবার উন্মুক্ততা সৃষ্টির ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা পালনসহ ব্যাপক সম্ভাবনা সৃষ্টির পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলে তথ্য-প্রযুক্তিতে দক্ষ ও উদ্যমী তরুণ উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা পালনের সম্ভাবনা তৈরি করেছে। ব্যাপক সম্ভাবনাময় প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও ইউডিসি’র সেবাসমূহ সম্পর্কে প্রচারণা খুব স্বল্প ও দুর্বল বলে উল্লেখ করে ড. জামান বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ বিভিন্ন গণযোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে সরকারকে এ বিষয়ে ব্যাপক প্রচারণার পরামর্শ প্রদান করেন।
সংবাদ সম্মেলনে ইউডিসি’র চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করে সম্ভাবনাসমূহ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে টিআইবি’র পক্ষ থেকে উত্থাপিত সুপারিশগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: ইউডিসি’র উদ্যোক্তাদের নির্বাচন ও তাদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা, চুক্তির মেয়াদ, মুনাফা বণ্টন, সেবামূল্য, ইউপি থেকে সহায়তা পাওয়ার শর্তাবলি এবং তথ্য সংরক্ষণ এবং তদারকির ক্ষেত্রে অংশীজনদের জন্য নির্দেশনাসহ প্রয়োজনীয় সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন। এছাড়াও সম্ভাব্যতা যাচাইপূর্বক এই প্রতিষ্ঠানের স্থায়ী প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের উদ্যোগ গ্রহণ; এটুআই-এর মূল উদ্দেশ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ সেবাসমূহের অগ্রাধিকার দিয়ে বর্তমানের সেবাসমূহের ব্যাপ্তি ও প্রসার সকল ইউডিসিতে একই রকম করা; নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে বিকল্প উৎস হিসেবে আইপিএস ব্যবহারের সুপারিশ করা হয়। এছাড়াও ইন্টারনেটের দ্রুত গতির জন্য সকল ইউপিতে অপটিক ফাইবারের মাধ্যমে ইন্টারনেট সংযোগ দ্রুত নিশ্চিত করা; অচল যন্ত্রপাতির মেরামত; এবং সরকারি সেবার বিপরীতে সরকারি ফি ও সেবামূল্য পৃথকভাবে উল্লেখপূর্বক রশিদ প্রদানের সুপারিশ প্রদান করে টিআইবি।
গণমাধ্যম যোগাযোগ,
রিজওয়ান-উল-আলম
পরিচালক, আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগ
মোবাইল: ০১৭১৩০৬৫০১২
ই-মেইল:rezwan@ti-bangladesh.org