সংবাদ বিজ্ঞপ্তি
বাংলাদেশে স্বর্ণখাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে টিআইবি’র আহ্বান
ঢাকা, ২৬ নভেম্বর ২০১৭: একটি সুষ্ঠু স্বর্ণ আমদানি-নীতির অনুপস্থিতিতে এবং সার্বিকভাবে দেশের স্বর্ণখাতের ওপর সরকারের কার্যকর নিয়ন্ত্রণের অভাবে স্বর্ণ ও স্বর্ণালংকারের মান এবং স্বর্ণবাজার ব্যবসায়ীদের দ্বারা একচেটিয়াভাবে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। অবৈধভাবে দেশের বাইরে থেকে আসা স্বর্ণালংকার বাংলাদেশের স্বর্ণবাজার ক্রমশ দখল করে ফেলেছে। স্বর্ণ ও স্বর্ণালংকারের মানযাচাই, ক্রেতা ও বিক্রেতার স্বার্থ সংরক্ষণ ও স্বর্ণ শিল্পী বা শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিতকরণে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থার ঘাটতি রয়েছে। সম্ভাবনাময় খাত হওয়া সত্ত্বেও উৎসাহমূলক পদক্ষেপ গৃহীত না হওয়ায় বাংলাদেশে রপ্তানি শিল্প হিসেবে স্বর্ণখাতের বিকাশ হয়নি। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) পরিচালিত একটি গবেষণায় উল্লিখিত পর্যবেক্ষণসমূহ উঠে এসেছে। ‘বাংলাদেশের স্বর্ণখাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা: চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’ শীর্ষক এ গবেষণাটির প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আজ সকালে টিআইবি’র ধানমন্ডিস্থ কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশে স্বর্ণখাতের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করে এ খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতে বেশ কিছু সুপারিশও পেশ করেছে টিআইবি। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এবং উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের। গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন টিআইবি’র গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান। সংশ্লিষ্ট গবেষক দলের অপর দুই সদস্য টিআইবি’র গবেষণা ও পলিসি বিভাগের প্রোগ্রাম ম্যানেজার মো. রেযাউল করিম এবং অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রোগ্রাম ম্যানেজার অমিত সরকার এ সময় উপস্থিত ছিলেন ।
স্বর্ণখাতের আইনি কাঠামো পর্যালোচনাসহ বিদ্যমান বহুমুখী সমস্যা ও চ্যালেঞ্জসমূহ চিহ্নিত ও স্বর্ণখাতকে একটি স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থার অধীনে আনার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সুপারিশমালা প্রণয়ণের উদ্দেশ্যে এ গুণগত গবেষণাটি জুলাই-নভেম্বর ২০১৭ সময়ের মধ্যে পরিচালিত হয়। গবেষণায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ ফাইনান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিট, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো, দুর্নীতি দমন কমিশন, শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রতিনিধি এবং সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সাক্ষাৎকার গৃহীত হয়েছে। এছাড়া, প্রাসঙ্গিক আইন, বিধিমালা, আদেশ, নির্দেশনা ও দলিলাদিসহ বই, প্রবন্ধ, গবেষণা ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ প্রতিবেদন পর্যালোচিত হয়েছে।
গবেষণায় দেখা যায়, দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে বার্ষিক ১৮-৩৬ মেট্রিক টন স্বর্ণের চাহিদা থাকা সত্ত্বেও এই চাহিদার সিংহভাগ চোরাচালানের মাধ্যমে পূরণ হচ্ছে। উচ্চ শুল্ক, অনুমোদনের ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াগত জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রতা এবং ফ্রেইট ও ইন্স্যুরেন্সের অপ্রাপ্যতা ইত্যাদি কারণে স্বর্ণব্যবসায়ীরা বৈধভাবে স্বর্ণ আমদানি না করে চোরাচালানকৃত স্বর্ণের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। দেশের স্বর্ণখাত জবাবদিহিতাহীন এবং এই খাত হিসাব-বহির্ভূত ও কালোবাজার থেকে সংগৃহীত স্বর্ণ-নির্ভর। সর্বোপরি চোরাচালান-প্রতিরোধ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের একাংশ (যারা স্বর্ণ চোরাচালান থেকে লাভবান) এবং বৃহৎ জুয়েলারী ব্যবসায়ীদের একাংশ (যারা সারাদেশে পাইকারী স্বর্ণ সরবরাহ করে) দেশে যাতে একটি সুষ্ঠু স্বর্ণ আমদানি নীতি প্রণীত না হয় এবং দেশের স্বর্ণখাত যাতে সুশাসন কাঠামোতে না আসে সেই লক্ষ্যে তৎপর থাকার অভিযোগ রয়েছে।
বিগত চার অর্থবছরে বিমানবন্দরে আটককৃত স্বর্ণের পরিমাণ ১,৬৭৪.৮৮১ কেজি এবং বৈধ পথে আমদানি না হওয়ায় স্বর্ণখাতে সরকারের ন্যূনমত রাজস্ব ক্ষতি বাৎসরিক ৪৮৭-৯৭৪ কোটি টাকা। চোরাচালান চক্রের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সিভিল অ্যাভিয়েশন কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের একাংশ, সরকারি ও বেসরকারি বিমান সংস্থা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের একাংশ, সংশ্লিষ্ট আইন-শৃৃঙ্খলা বাহিনীর একাংশসহ বিমানে খাদ্য ও পানীয় সরবরাহকারী ও পরিচ্ছন্ন-কর্মীদের একাংশের জড়িত থাকার তথ্য গবেষণায় উঠে এসেছে।
চোরাচালানের অভিযোগে দায়েরকৃত মামলা বিশেষ ক্ষমতা আইন, ১৯৭৪ এ রুজু হয়। অন্যদিকে, বিশেষ ক্ষমতা আইন, ১৯৭৪ এর অধীন চোরাচালানের অপরাধ অজামিনযোগ্য হলেও বাস্তবক্ষেত্রে দুর্বল তদন্ত ও অভিযোগ গঠন, অপর্যাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ সাক্ষীর অনুপস্থিতি ইত্যাদি কারণে চোরাচালানের অভিযোগে অভিযুক্তরা উচ্চ আদালত থেকে সহজে জামিন যায় এবং পুনরায় চোরাচালানের কাজে জড়িয়ে পড়ে।
এই গবেষণায় বিদ্যমান হারে শুল্ক পরিশোধ সাপেক্ষে বৈধভাবে স্বর্ণ আমদানির কোনো দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়নি। যাত্রী (অপর্যটক) ব্যাগেজ (আমদানি) বিধিমালা, ২০১৬ অনুযায়ী অনধিক ২৩৪ গ্রাম স্বর্ণপি- প্রতি ভরি তিন হাজার টাকা, ১০০ গ্রামের অতিরিক্ত প্রতি গ্রাম স্বর্ণালঙ্কার ১৫০০ টাকা নির্ধারিত শুল্ক পরিশোধ সাপেক্ষে এবং অনধিক ১০০ গ্রাম ওজনের স্বর্ণালঙ্কার (এক প্রকার অনধিক ১২টি) শুল্ক পরিশোধ ছাড়া দেশে আনার সুযোগ পেয়ে থাকেন। কিন্তু একজন যাত্রী বছরে কতবার এই সুযোগ গ্রহণ করতে পারবেন সে বিষয়ে এই বিধিমালায় কোনো নিদের্শনা না থাকায় বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে এই সুযোগ ব্যবহার করে স্বর্ণ ও স্বর্ণালংকার দেশে আনা হচ্ছে।
গবেষণায় বাংলাদেশের স্বর্ণখাতের বেশকিছু চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করা হয়েছে। চ্যালেঞ্জসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: দেশের স্বর্ণবাজারে সরকারি কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থার তত্ত্বাবধান, পরিবীক্ষণ তথা জবাবদিহিতার ব্যবস্থা না থাকা; আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের কারিগরদের তৈরি স্বর্ণালঙ্কারের চাহিদা থাকলেও রপ্তানির জন্য প্রয়োজনীয় প্রণোদনার ঘাটতি; ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত স্বর্ণ ও স্বর্ণালঙ্কারের মজুত সংক্রান্ত তথ্য না থাকা; জেলা প্রশাসন থেকে ব্যবসায়ী কর্তৃক প্রয়োজনীয় লাইসেন্স গ্রহণ ও নিয়মিত নবায়ন না করায় সরকারের রাজস্ব ক্ষতি; খুচরা বাজারে স্বর্ণ বা স্বর্ণালঙ্কারের ক্রয়-বিক্রয়ে সর্বক্ষেত্রে ইসিআর বা মূসক চালানের ব্যবহার না হওয়ায় ভ্যাট ফাঁকির ঝুকি; ব্যবসায়ীদের ইচ্ছা দ্বারা স্বর্ণ ও স্বর্ণালঙ্কারের মূল্য নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হওয়া; অবৈধ বিদেশি স্বর্ণালঙ্কার ক্রয়-বিক্রয়ের প্রসার অব্যাহত থাকা; এবং স্বর্ণ বা স্বর্ণালঙ্কার ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে বৃহৎ লেনদেন ব্যাংকিং ব্যবস্থা বা ইলেক্ট্রনিক ট্রান্সফারের মাধ্যমে লেনদেন বাধ্যতামূলক না হওয়ায় অর্থপাচারসহ অবৈধ লেনদেনের ঝুঁকি।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, চোরাচালানি নির্ভর স্বর্ণব্যবসায় সংশ্লিষ্ট আইন-সৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাংশ, স্থলবন্দর ও বিমানের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একাংশ এবং এদের সাথে ব্যবসায়ী ও চোরাকারবারিদের যোগসাজশের মাধ্যমে অবৈধতা এবং অনিয়ম অব্যাহত রয়েছে। শুধু তাই নয়, এই চক্রটির একাংশ এই দেশে একটি পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা হোক বা বিস্তৃত আইন প্রণয়ন হোক সেক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অনেক সময় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। স্বর্ণখাতের অনিয়ন্ত্রিত বাজার এবং এই খাতে পর্যবেক্ষণ বা সুপারভিশন-মনিটরিং পরিবীক্ষণের ঘাটতিসহ আইনের প্রয়োগের ঘাটতির ফলে একদিকে স্বর্ণখাতে কর্মরত কর্মী ও শিল্পীদের অধিকার হরণ হচ্ছে, অন্যদিকে স্বর্ণের ভোক্তা বা সাধারণ জনগণ অতিরিক্ত মূল্য প্রদানসহ বিভিন্নভাবে প্রতারিত হচ্ছেন। সর্বোপরি বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে সরকার বঞ্চিত হচ্ছে। স্বর্ণখাতকে একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত হিসেবে উল্লেখ করে ড. জামান আরো বলেন, স্বর্ণখাতের মতো একটি জনপ্রিয় ও জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট খাতে অনৈতিকতা এভাবে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করবে, চোরাকারবারি নির্ভর ব্যবসা চিরজীবন চলতে থাকবে, এটা আমরা আশা করি না।
বাংলাদেশে স্বর্ণখাতের চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবিলা করে এ খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে টিআইবি’র পক্ষ থেকে উত্থাপিত সুপারিশগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: স্বর্ণখাত সংশ্লিষ্ট সকল পর্যায়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে একটি পূর্ণাঙ্গ আইন প্রণয়ন; সকল স্বর্ণ ও স্বর্ণালংকার ব্যবসায়ীকে তাদের প্রতিষ্ঠানের মজুত সকল স্বর্ণ ও স্বর্ণালংকার কর প্রদান সাপেক্ষে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নিবন্ধনের সুযোগ প্রদান; এবং সকল ব্যবসায়ী কর্তৃক সরকার নির্ধারিত লাইসেন্স গ্রহণ ও প্রযোজ্য ক্ষেত্রে নবায়ন বাধ্যমূলক করা; এছাড়াও ব্যাগেজ রুলের মাধ্যমে আনা স্বর্ণালংকারের বাণিজ্যিক ব্যবহার নিষিদ্ধ ও শাস্তি নিশ্চিত করা; বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআর এর সার্বিক তত্ত্বাবধানে নির্ধারিত সরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে স্বর্ণ আমদানির ব্যবস্থা; স্বর্ণ আমদানি ও ক্রয়-বিক্রয় অবাধ করেছে এমন দেশের অভিজ্ঞতা বিবেচনায় স্বর্ণের আমদানি অন্য পণ্যের ন্যায় অবাধ করা; এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো বিবেচনা করে স্বর্ণ আমদানির শুল্কহার পর্যায়ক্রমে কমিয়ে আনার সুপারিশ করা হয়।
অন্যদিকে, স্থল ও বিমানবন্দরের প্রতিটি আগমন ও বহির্গমন দরজায় সর্বাধিক প্রযুক্তির স্ক্যানার ও আর্চ-ওয়ে স্থাপন এবং শুল্ক কর্মকর্তার উপস্থিতি নিশ্চিতসহ স্বর্ণ চোরাচালান নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষসমূহের যেমন- বাংলাদেশ ফাইনান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিট, শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর এবং সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, এনবিআর, দুদক ইত্যাদির মধ্যে কার্যকর সমন্বয় নিশ্চিতের সুপারিশ করেছে টিআইবি।
গণমাধ্যম যোগাযোগ,
রিজওয়ান-উল-আলম
পরিচালক, আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগ
মোবাইল: ০১৭১৩০৬৫০১২,
ই-মেইল:rezwan@ti-bangladesh.org