এনসিটিবি’র ১৬টি ধাপে সুশাসনের ঘাটতি চিহ্নিত; রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে কার্যক্রম পরিচালনার আহ্বান টিআইবি’র

সংবাদ বিজ্ঞপ্তি
 
এনসিটিবি’র ১৬টি ধাপে সুশাসনের ঘাটতি চিহ্নিত; রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে কার্যক্রম পরিচালনার আহ্বান টিআইবি’র
 
ঢাকা, ১৩ নভেম্বর ২০১৭: জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড’র (এনসিটিবি) পাণ্ডুলিপি প্রণয়ন ও পাঠ্যপুস্তক প্রকাশনা ও সরবরাহের সর্বমোট ২০টি ধাপের মধ্যে ১৬টি ধাপে সুশাসনের ঘাটতি, রাজনৈতিক প্রভাব ও অনিয়ম-দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এনসিটিবি’র কার্যক্রমের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতে ১৬ দফা সুপারিশ পেশ করেছে। টিআইবি পরিচালিত ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি): পাণ্ডুলিপি প্রণয়ন ও প্রকাশনা ব্যবস্থায় সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণাটির প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আজ সকালে টিআইবি’র ধানমন্ডিস্থ কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে মেধাভিত্তিক সমাজ গঠনে এনসিটিবি’কে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানানো হয়। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের এবং গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান ও সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার শাহজাদা এম আকরাম। গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন টিআইবি’র গবেষণা ও পলিসি বিভাগের ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার মোরশেদা আক্তার।
এনসিটিবি’র পাণ্ডুলিপি প্রণয়ন ও প্রকাশনার ক্ষেত্রে সুশাসনের চ্যালেঞ্জসমূহ চিহ্নিত ও তা মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় সুপারিশ প্রদানের উদ্দেশ্যে গবেষণাটি অক্টোবর ২০১৬ থেকে অক্টোবর ২০১৭ সময়ের মধ্যে পরিচালিত হয়। গুণগত এ গবেষণায় এনসিটিবি’র কর্মকর্তা-কর্মচারী, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, প্রাথমিক শিক্ষা এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা, পাণ্ডুলিপি প্রণয়ন কমিটির সদস্য, পাণ্ডুলিপি লেখক, সংশ্লিষ্ট সম্পাদক, গবেষক ও শিক্ষাবিদ, তদারকি প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, দাতা সংস্থার প্রতিনিধি এবং গণমাধ্যম কর্মীর সাক্ষাৎকার গৃহীত হয়েছে। এছাড়াও, সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধি, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক প্রতিবেদন, বিভিন্ন প্রকাশনা ও প্রতিবেদনসহ গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ প্রতিবেদন পর্যালোচিত হয়েছে।
গবেষণায় দেখা যায়, আইনগতভাবে স্বায়ত্তশাসিত হলেও এনসিটিবি’র কার্যক্রমে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ বিদ্যমান। সরকার এনসিটিবি’র সুপারিশক্রমে শিক্ষামন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে লেখক কমিটি, শিক্ষাক্রম উন্নয়ন কমিটি ও টেকনিক্যাল কমিটিসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কমিটির সদস্য নিয়োগ চূড়ান্ত করে। বিষয়টি সরকারের এখতিয়ারভুক্ত হওয়ায় এসকল কমিটির সদস্য নিয়োগে রাজনৈতিক প্রভাব কাজ করে। এনসিটিবি’র কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যথাযথ জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে না পারায় তারা বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পরছে। অন্যদিকে, পরিদর্শন ও তদারকিতে ঘাটতির কারণে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মানসম্মত পাঠ্যবই সরবরাহ করা সম্ভব হয় না। পাঠ্যবই লেখার মতো বিশেষায়িত বিষয় যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হয় না এবং অনেক ক্ষেত্রে প্রকৃত বিশেষজ্ঞদের এই প্রক্রিয়ার অন্তর্ভুক্ত না করার অভিযোগ রয়েছে। পাঠ্যবইয়ে ক্ষমতাসীন দলের মতাদর্শী ধারার ভাষা ব্যবহারের প্রবণতা এবং ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর প্রভাব লক্ষ্যণীয়। এছাড়া, প্রতিষ্ঠানটিতে বিশেষজ্ঞ, জনবল ও কারিগরী দক্ষতার যথেষ্ট ঘাটতি থাকার তথ্যও এ গবেষণায় পাওয়া গেছে।
এনসিটিবি’র দরপত্র কমিটির একাংশের বিরুদ্ধে পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে আগেই দর জানিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে অবৈধ আর্থিক সুবিধা গ্রহণের এবং দরপত্র আহ্বানের পর এনসিটিবি’র কতিপয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বেনামে মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের মালিক হিসেবে দরপত্রে অংশগ্রহণ ও কার্যাদেশ প্রাপ্তির অভিযোগ রয়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মুদ্রণ, বাঁধাই ও লেমিনেশনের কার্যাদেশ প্রাপ্তির পর কাজের বেশিরভাগই অবৈধভাবে সাব-কন্ট্রাক্টে দেওয়ার তথ্যসহ অবৈধ আর্থিক সুবিধার বিনিময়ে বিএসটিআই সনদবিহীন কাগজের কারখানাকে এনসিটিবি কর্তৃক কাগজ সরবরাহের কার্যাদেশ প্রদান করার অভিযোগও গবেষণায় পাওয়া গিয়েছে। এছাড়াও, মান নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বপ্রাপ্ত তদারকি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সার্বক্ষণিক উপস্থিত না থেকেও উপস্থিতির প্রতিবেদন দেওয়া, মুদ্রণ কাজে নিম্নমানের কাগজ ও কালির ব্যবহার, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মুদ্রণ সম্পন্ন না হওয়া সত্ত্বেও আর্থিক সুবিধার বিনিময়ে সন্তোষজনক প্রতিবেদন প্রদানের তথ্য গবেষণায় উঠে এসেছে।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, মেধাভিত্তিক সমাজ গঠনে রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকার বাস্তবায়নকারী সংস্থা এনসিটিবি কর্তৃক সম্প্রতি একটি বিশেষ সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর চাহিদার প্রেক্ষিতে পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন ও সংশোধন আনা হয়েছে, যার অনেক কিছুই বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা ও মৌলিক চেতনার পরিপন্থী। অন্যদিকে, দীর্ঘদিনেও এনসিটিবি’র পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় বিধি জারি না হওয়ায় মন্ত্রণালয়ের দ্বারা আদিষ্ট হয়ে এনসিটিবি’কে তার কার্যক্রম পরিচালনা করতে হচ্ছে বলে তিনি অভিমত প্রকাশ করেন। ড. জামান জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সুখ্যাতিসম্পন্ন বিশেষজ্ঞদের সম্পৃক্ত করে সাময়িকভাবে গঠিত একটি বিশেষ কমিটির মাধ্যমে এনসিটিবি’কে একটি স্বাধীন কমিশন হিসেবে পুনর্গঠনের দাবি জানান। তিনি বলেন, এই বিশেষ কমিটির ওপর কমিশন গঠন প্রক্রিয়া, কমিশনের দায়িত্ব, কার্যপ্রণালী ও  জবাবদিহিতার প্রক্রিয়া চিহ্নিত করে কমিশন গঠন প্রক্রিয়া নির্ধারণে একটি আইন তৈরির দায়িত্ব প্রদান করা যেতে পারে এবং এই আইনের ভিত্তিতে এনসিটিবি’কে একটি কমিশন হিসেবে পুনর্গঠনের জন্য সরকার উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে।
 এনসিটিবি’র পাণ্ডুলিপি প্রণয়ন ও প্রকাশনা প্রক্রিয়ায় সুশাসন ও কার্যকর জবাবদিহিতার পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে এনসিটিবি’র কার্যক্রমে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাব হ্রাস করা; শিক্ষাক্রম ও পাণ্ডুলিপি প্রণয়নের জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন; বর্তমান পাঠ্যক্রমের প্রকাশ বা উন্মুক্তকরণ; অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের এনসিটিবি’র বোর্ডে সদস্য হিসেবে নিয়োগ; জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল অনুযায়ী এনসিটিবি’র কর্মীদের জন্য আচরণবিধি প্রণয়ন এবং সকল তদন্ত প্রতিবেদন ওয়েবসাইটে প্রকাশের সুপারিশ উল্লেখযোগ্য।
এছাড়াও, প্রতিটি পাঠ্যবইয়ের জন্য সম্পাদক, সংকলক ও লেখকদের সাথে এনসিটিবি’র চুক্তির প্রথা প্রবর্তন; দক্ষতাসম্পন্ন লেখক নিয়োগ ও সুনির্দিষ্ট কাঠামোর আওতায় লেখকদের সম্মানি নির্ধারণ এবং পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণে ই-টেন্ডারিং প্রথা চালুর সুপারিশ করেছে টিআইবি।
গণমাধ্যম যোগাযোগ,
 
রিজওয়ান-উল-আলম
পরিচালক, আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগ
মোবাইল: ০১৭১৩০৬৫০১২
ই-মেইল: rezwan@ti-bangladesh.org
 

Press Release