সংবাদ বিজ্ঞপ্তি
নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের দায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের, স্বল্পতম সময়ে তাদের স্বদেশে ফিরে যাওয়ার উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টির আহ্বান টিআইবি’র
ঢাকা, ১ নভেম্বর ২০১৭: সরকার মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলপূর্বক বাস্তুচ্যূত মায়ানমার নাগরিকদের (রোহিঙ্গা) বাংলাদেশে আশ্রয় দিয়ে প্রশংসনীয় কাজ করলেও দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের একার পক্ষে এই বোঝা বহন সম্ভব নয় উল্লেখ করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) গৃহহীন ও নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের দায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বহনের এবং স্বল্পতম সময়ের মধ্যে রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফিরে যাওয়ার উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টিতে মায়ানমারের ওপর সুনির্দিষ্ট নিষেধাজ্ঞা আরোপের আহ্বান জানিয়েছে। টিআইবি পরিচালিত ‘বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মায়ানমারের নাগরিকদের (রোহিঙ্গা) বাংলাদেশে অবস্থানজনিত সমস্যা: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ বিষয়ক সমীক্ষা’ এর প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আজ সকালে টিআইবি’র ধানমন্ডিস্থ কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এ আহ্বান জানান। সংকট মোকাবিলায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সকল অংশীজনদের সম্পৃক্ত করে অবিলম্বে মায়ানমারের ওপর কূটনৈতিক চাপ ও কঠোর অবরোধ আরোপের মাধ্যমে দ্রুত সকল বাস্তুচ্যূত মায়ানমার নাগরিকদের প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করা এবং প্রত্যাবর্তন সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত সকল আন্তর্জাতিক অংশীজনদের অংশগ্রহণে ত্রাণতৎপরতার ব্যয় প্রাক্কলন ও নির্বাহের আহ্বানও জানিয়েছে টিআইবি। সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন টিআইবি’র উপদেষ্টা, নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের এবং গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান। সমীক্ষা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন টিআইবি’র জলবায়ু অর্থায়নে সুশাসন ইউনিটের প্রোগ্রাম ম্যানেজার গোলাম মহিউদ্দিন। এ সময় আরো উপস্থিত ছিলেন সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারী টিআইবি’র জলবায়ু অর্থায়নে সুশাসন ইউনিটের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রোগ্রাম ম্যানেজার, গবেষণা মো: রাজু আহমেদ মাসুম।
বাংলাদেশে অবস্থানরত বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মায়ানমারের নাগরিকদের (রোহিঙ্গা) ত্রাণ ও আশ্রয় ব্যবস্থাপনার ওপর একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট চ্যালেঞ্জসমূহ চিহ্নিত করার উদ্দেশ্যে সমীক্ষাটি সেপ্টেম্বর ২০১৭ থেকে অক্টোবর ২০১৭ সময়ের মধ্যে পরিচালিত হয়।
সমীক্ষায় রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের সীমান্তে প্রবেশ থেকে শুরু করে অস্থায়ী শিবিরে পৌঁছানোর পদ্ধতি, মৌলিক চাহিদাসহ বিভিন্ন সহযোগিতা প্রদানে গৃহীত উদ্যোগ, রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া, ত্রাণ ব্যবস্থাপনা, পরিবেশগত বিপর্যয়ের শঙ্কা, সংশ্লিষ্ট অংশীজনের দায়িত্ব ও সমন্বয় এবং বিভিন্ন অপরাধ ও দুর্নীতির ঝুঁকি পর্যালোচনা করা হয়। সুশাসনের চারটি নির্দেশক- স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, সমতা ও সংবেদনশীলতার আলোকে সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
গুণগত এ গবেষণায় সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠান, আন্তর্জাতিক সংস্থা, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মুখপাত্র, সাংবাদিক, স্থানীয় বাংলাদেশি নাগরিক ও আশ্রয়প্রার্থী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী তথ্যের প্রাথমিক উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। পরোক্ষ উৎস হিসেবে সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের ওয়েবসাইট এবং গণমাধ্যমের তথ্য ব্যবহৃত হয়েছে।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “মায়ানমার সরকার ও সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিকল্পিতভাবে জাতিগত নিধনের লক্ষ্যে পরিচালিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মাধ্যমে বাংলাদেশের ওপর চাপিয়ে দেওয়া দশ লক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থীর অভূতপূর্ব বোঝা বাংলাদেশের একার নয়, বরং মূলত মায়ানমার সরকার ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের।” তিনি বলেন, ক্ষমতাধর আন্তর্জাতিক শক্তিসমূহের স্বার্থপ্রসূত দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থনই মায়ানমার সেনাবাহিনীকে এ নৃশংসতার পথ অবলম্বনে উৎসাহিত করেছে। মায়ানমারের এ হত্যাযজ্ঞ ও নৃশংসতার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কর্তৃক কোন প্রকার কার্যকর পদক্ষেপ, বিশেষ করে সুনির্দিষ্ট অর্থনৈতিক বিনিয়োগ, উন্নয়ন, বাণিজ্য ও সামরিক সহায়তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপে চলমান ব্যর্থতা এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে যে বিতাড়িত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর স্বদেশে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হচ্ছে। বাংলাদেশের একার পক্ষে এ বোঝা বইবার সামর্থ বা যুক্তি কোনটাই নেই উল্লেখ করে ড. জামান বলেন, “দশ লক্ষ গৃহহীন ও নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের দায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেই নিতে হবে এবং স্বল্পতম সময়ের মধ্যে তাদের স্বদেশে ফিরে যাবার উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।”
সমীক্ষায় দেখা যায়, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া মায়ানমারের নিপীড়িত, নির্যাতিত ও নৃসংশতার শিকার রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মৌলিক চাহিদাসহ বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন ইতিবাচক উদ্যোগ গ্রহণ সত্ত্বেও তারা খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানসহ বিশুদ্ধ পানি, পয়ঃনিষ্কাশন ও স্বাস্থ্যজনতি ব্যাপক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। শরণার্থীদের প্রতিনিধি, স্থানীয় কতিপয় জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং এক শ্রেণির অসাধু চক্র কর্তৃক যোগসাজশের মাধ্যমে ত্রাণসামগ্রী আত্মসাৎ ও চাঁদাবাজির কারণে বিভিন্নভাবে প্রতারিত হচ্ছে বাস্তুচ্যুত শরণার্থীরা। বিপুল সংখ্যক শরণার্থী ব্যবস্থাপনায় জাতীয় নিরাপত্তা ঝুঁকিসহ সামাজিক, অর্থনৈতিক, স্বাস্থ্য, ও পরিবেশগত দীর্ঘমেয়াদী বিপর্যয়ের ঝুঁকির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। রোহিঙ্গাদের কোনো পূর্ণাঙ্গ তালিকা না থাকায় ত্রাণ বিতরণসহ অন্যান্য সহায়তার ক্ষেত্রে সমতা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। নিরাপদ খাবার পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার এখনো ব্যাপক অপ্রতুলতা রয়েছে। এ সংক্রান্ত যে সকল স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে তার তদারকি ব্যবস্থায় ঘাটতি রয়েছে। স্থাপিত নলকূপগুলোর ৩০ শতাংশ দ্রুত মেরামত করা প্রয়োজন। উপযুক্ত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার অভাব বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাবের ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে। এছাড়া প্রদত্ত অস্থায়ী টয়লেটগুলোর ৩৬ শতাংশ অল্প দিনের মধ্যেই ভরাট হয়ে যাবে।
সমীক্ষাটির পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, শরণার্থীদের চাহিদার তুলনায় স্বাস্থ্যসেবা অত্যন্ত অপ্রতুল এবং তার ওপর বিভিন্ন পানিবাহিত ও সংক্রামক রোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়াও শরণার্থীদের মধ্যে এইড্স- এ আক্রান্ত রোগী সনাক্ত হয়েছে যা বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে। প্রতিনিয়ত উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মকর্তাসহ আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ পরিদর্শকদের প্রটোকল প্রদানে জেলা প্রশাসন ব্যস্ত থাকার কারণে ত্রাণ ব্যবস্থাপনার সার্বিক তদারকিতে প্রয়োজনীয় সমন্বয়ের ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। রোহিঙ্গাদের ব্যবস্থাপনা ব্যয় সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতি এবং উন্নয়নে বিরূপ প্রভাব ফেলার ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে। এছাড়াও, বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবিলায় নিয়োজিত ৩৯টি আন্তর্জাতিক সংস্থা ও ১৬টি জাতীয় বেসরকারি সংস্থার মধ্যে সমন্বয়কারী দল ইন্টার সেক্টর কো-অর্ডিনেশন গ্রুপ (আইএসসিজি) প্রকাশিত প্রতিষ্ঠানভিত্তিক কার্যক্রমের বিস্তারিত তথ্যের অধিকাংশই উন্মুক্ত নেই।
আইএসসিজি প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, ২৫ আগস্ট ২০১৭ সহিংসতা শুরুর পর থেকে ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত বাংলাদেশে নতুন করে আশ্রয় নেওয়া পাঁচ লক্ষ ৩৬ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীর খাদ্য চাহিদা উল্লিখিত সময় পর্যন্ত পূরণ করা সম্ভব হলেও সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, আন্তর্জাতিক সহায়তায় ত্রাণ সরবরাহ এবং ত্রাণসামগ্রীর পর্যাপ্ততা নিশ্চিত করা সম্ভব না হলে দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশ কর্তৃক এই বিপুল জনগোষ্ঠীর বিবিধ চাহিদা পূরণ অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। উল্লিখিত সময় পর্যন্ত শরণার্থীদের মধ্যে ৫৫ হাজার গর্ভবতী নারীর পুষ্টিসেবা চাহিদার বিপরীতে মাত্র ১২ হাজার ৬৬২ জন এবং পাঁচ বছরের কম বয়সী এক লক্ষ ৫০ হাজার শিশুর পুষ্টিসেবা চাহিদার বিপরীতে ৪৯ হাজার ৩০৬ শিশুর পুষ্টিসেবা প্রদান করা সম্ভব হয়েছে। ২৯ অক্টোবর পর্যন্ত শরণার্থীদের জন্য ২৫ হাজার নলকূপের চাহিদার বিপরীতে মাত্র ৪ হাজার ৩৭০টি নলকূপ, ৩৮ হাজার অস্থায়ী স্যানিটারী টয়লেটের চাহিদার বিপরীতে ২৪ হাজার ৭৭৩টি টয়লেট স্থাপন করা সম্ভব হয়েছে এবং ১১ লক্ষ ৬৬ হাজার মানুষের পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন সেবার আওতায় নিয়ে আসার চাহিদার বিপরীতে ৫ লক্ষ ৩০ হাজার মানুষকে এ সেবার আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে। ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত এক লক্ষ ৫০ হাজার শিশুর জন্য পোলিও ভ্যাকসিন ও ভিটামিন এ ক্যাপসুলের চাহিদার বিপরীতে ৭২ হাজার ৩৩৪ শিশুকে এ সেবা প্রদান করা সম্ভব হয়েছে।
সমীক্ষায় দেখা যায়, সীমান্ত অতিক্রম থেকে আশ্রয়স্থলে পৌঁছানো ও আশ্রয় শিবিরে পুনর্বাসন পর্যন্ত রোহিঙ্গা শরণার্থীরা বিভিন্ন অসাধু চক্রের হাতে বিভিন্ন পর্যায়ে প্রতারণা ও চাঁদাবাজির শিকার হয়েছে। প্রকৃত ভাড়া ২০০-২৫০ টাকা হলেও, সীমান্ত পাড়ির সময় মায়ানমারের নৌকার মাঝিদের জনপ্রতি গড়ে ৫ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা অথবা অর্থের বদলে সোনার গহনা দিতে হচ্ছে। মুদ্রা বিনিময়ের ক্ষেত্রে প্রতি এক লক্ষ কিয়াটের বিপরীতে ৬ হাজার টাকা প্রাপ্তির কথা থাকলেও দালালদের কাছ থেকে তারা পাচ্ছে ২ হাজার থেকে ৪ হাজার পাঁচশ টাকা এবং বাংলাদেশি মুদ্রার মান জানা না থাকায় স্থানীয় যানবাহন ব্যবহারের ক্ষেত্রে শরণার্থীদের অতিরিক্ত ভাড়া প্রদান করতে হচ্ছে। এছাড়াও, আশ্রয়ঘর নির্মাণের জন্য প্রতিটি পরিবার কর্তৃক একটি অসাধু চক্রকে গড়ে ২ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা দিতে হয়েছে এবং প্রতিটি ধাপের প্রতারণার সাথেই স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ পাওয়া গেছে। রোহিঙ্গা প্রতিনিধি ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে যোগসাজশের মাধ্যমে ত্রাণের টোকেন বিক্রয়, ত্রাণসামগ্রী আত্মসাৎ ও রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে অবৈধ উপায়ে অর্থ আদায়সহ তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপরাধ ও দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সমীক্ষায় নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট কিছু পর্যবেক্ষণ উঠে এসেছে। শরণার্থী ব্যবস্থাপনায় সীমান্ত পথগুলোর নিয়ন্ত্রণে এবং সীমান্ত পথে মাদক ও আগ্নেয়াস্ত্র পাচার রোধে নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকা; রোহিঙ্গাদের একাংশের, বিশেষ করে রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদের কাছে বাংলাদেশে পরিচালিত মোবাইল ফোন অপারেটরের সিম কার্ড যুক্ত মোবাইল ফোন সেট থাকা; রোহিঙ্গাদের নিজেদের মধ্যে এবং রোহিঙ্গাদের দ্বারা সংঘটিত হত্যা, ধর্ষণ প্রভৃতি অপরাধ ব্যতীত অন্য অপরাধসমূহ নিরসনের আইনি প্রক্রিয়া নির্ধারণ না হওয়া; এবং বায়োমেট্রিক নিবন্ধন প্রক্রিয়াতে লোকবলের ও নিবন্ধন কেন্দ্রের সংখ্যার অপর্যাপ্ততা। নিরাপত্তা বিষয়ক অন্য পর্যবেক্ষণগুলোর মধ্যে দ্রুত পূর্ণাঙ্গ তালিকা সম্পন্ন করে ত্রাণ বিতরণে সমতা নিশ্চিত না করলে আশ্রয়প্রার্থীদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টির সম্ভাবনা এবং সহিংসতা সৃষ্টির ঝুঁকি; শিবিরগুলোতে বিভিন্ন অপরাধ ও সহিংসতা বৃদ্ধির আশঙ্কা; এবং পরিস্থিতির সুযোগে স্বার্থান্বেষী মহল কর্তৃক মাদক চোরাচালান, হত্যা, লুটপাট ও সন্ত্রাসী কর্মকা-সহ বিভিন্ন অপরাধে রোহিঙ্গাদের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য।
পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, রোহিঙ্গা সংকট পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে স্থিতিশীলতা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিরুদ্ধে একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এবং এ সংকটের সুযোগে সংশ্লিষ্ট এলাকার বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের সাথে রোহিঙ্গাদের যোগসাজশ প্রতিষ্ঠার ঝুঁকি রয়েছে। রোহিঙ্গা নারীদের যৌন ব্যবসায় জড়িয়ে ফেলার ঝুঁকিসহ রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের অন্যান্য জেলায় ছড়িয়ে গেলে তা বহুমুখী সামাজিক, অর্থনৈতিক ও জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত দীর্ঘমেয়াদী ঝুঁকির কারণ হবে। রোহিঙ্গাদের মধ্যে সাংগঠনিক ক্ষমতা কাঠামো তৈরি হচ্ছে যা শুরু থেকে নিয়ন্ত্রণ না করলে একটি জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা হিসেবে পরিণত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। অবাধ সীমান্ত অতিক্রমের সুযোগ ব্যবহার করে মাদক চোরাচালান ও মানব পাচারসহ বিভিন্ন ঝুঁকি উল্লেখযোগ্য ভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার তথ্যও সমীক্ষায় পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় সুশাসন প্রতিষ্ঠা, দুর্নীতি প্রতিরোধ এবং আর্থ-সামাজিক ও নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকি মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকার, আন্তর্জাতিক সংস্থা, দাতা সংস্থা, রাষ্ট্র এবং সংশ্লিষ্ট সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বিবেচনার জন্য সমীক্ষায় বেশ কিছু সুপারিশ প্রদান করা হয়েছে।
সরকারের বিবেচনার জন্য উত্থাপিত সুপারিশগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রত্যাবর্তনের প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করতে সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সম্পৃক্ত করে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদারকরণ এবং রোহিঙ্গা ব্যবস্থাপনায় প্রয়োজনীয় বহুমুখী আর্থিক ব্যয় প্রাক্কলন করে তা নির্বাহে আন্তর্জাতিক সহায়তা নিশ্চিতকরণে উদ্যোগ গ্রহণ। আন্তর্জাতিক সংস্থা, রাষ্ট্র ও দাতা সংস্থাসমূহের বিবেচনার জন্য শুধু ত্রাণ সহায়তা নয়, রোহিঙ্গাদের দ্রুত প্রত্যাবর্তন নিশ্চিতে মায়ানমারের ওপর সমন্বিত কূটনৈতিক প্রভাব, বিশেষ করে সুনির্দিষ্ট চাপ প্রয়োগ করার সুপারিশ করা হয়। ব্যবস্থাপনার সাথে সংশ্লিষ্ট সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের উদ্দেশে পর্যাপ্ত জনবল সরবরাহের মাধ্যমে যত দ্রুত সম্ভব সকল রোহিঙ্গার বায়োমেট্রিক নিবন্ধন সম্পন্নকরণ এবং প্রয়োজনে এ বিষয়ে উৎসাহ প্রদানের জন্য ত্রাণপ্রাপ্তির সঙ্গে এই নিবন্ধনের বাধ্যবাধকতা আরোপের সুপারিশসহ সংশ্লিষ্ট অংশীজন ও বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ চাহিদা ও ঝুঁকি বিশ্লেষণমূলক সমীক্ষা এবং সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে পর্যাপ্ততা ও সমতা নিশ্চিতকরণের সুপারিশ করা হয়। এছাড়াও, সীমান্ত অতিক্রম, মুদ্রা বিনিময়, অবস্থান গ্রহণসহ বিভিন্ন বিষয়ে যারা রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা গ্রহণ করেছে তাদের যথাযথভাবে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়ায় দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ এবং পুরো প্রক্রিয়ায় সার্বিকভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর তদারকি কার্যক্রম বৃদ্ধি করাসহ নির্দিষ্ট বিরতিতে প্রতিবেদন প্রণয়ন ও প্রকাশ এবং সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সমন্বয়ে একটি কার্যকর অভিযোগ নিরসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করা হয়।
অন্য সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে: পরিবেশ, বনায়ন ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি রোধে সংশ্লিষ্ট সকল অংশীজনদের সমন্বয়ে অনতিবিলম্বে একটি পরিকল্পনা ও প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ; রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশের ক্ষেত্রে সীমান্তে একটি প্রাথমিক তালিকাভুক্তির ব্যবস্থা করা এবং এই অনুপ্রবেশকে কাজে লাগিয়ে যাতে মাদক ও অন্যান্য দ্রব্যাদি চোরাচালান না হয় তা নিশ্চিতকরণ; এছাড়াও ত্রাণের টোকেন বিতরণে সংঘটিত অনিয়ম ও দুর্নীতি প্রতিরোধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ; ক্যাম্প এলাকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারকরণ; প্রতিবন্ধী ও অনাথ শিশুদের তালিকা দ্রুত সম্পন্নকরণ এবং তাদের জন্য প্রয়োজনীয় বিশেষায়িত ব্যবস্থা গ্রহণ; গর্ভবতী নারী ও শিশুদের জন্য মাতৃ ও শিশুসেবা নিশ্চিত করা; রোহিঙ্গাদের জন্ম নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করা; এবং রোহিঙ্গা ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত সকল সরকারি ও বেসরকারি বিস্তারিত তথ্যের জন্য একটি সমন্বিত ওয়েবসাইট তৈরি করাসহ নির্দিষ্ট সময় পর তা হালনাগাদকরণ।
গণমাধ্যম যোগাযোগ,
রিজওয়ান-উল-আলম
পরিচালক, আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগ
মোবাইল: ০১৭১৩০৬৫০১২
ই-মেইল: rezwan@ti-bangladesh.org