টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট’র দুর্নীতি প্রতিরোধ ও সুশাসন বিষয়ক লক্ষ্য অর্জনে অনিয়ম ও দুর্নীতি বড় বাধা

সংবাদ বিজ্ঞপ্তি
 
টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট’র দুর্নীতি প্রতিরোধ ও সুশাসন বিষয়ক লক্ষ্য অর্জনে অনিয়ম ও দুর্নীতি বড় বাধা
 
ঢাকা, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭: টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) ১৬’র দুর্নীতি প্রতিরোধ ও সুশাসন বিষয়ক লক্ষ্যগুলো অর্জনে বাংলাদেশে প্রচলিত আইন, নীতি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো যথেষ্ট পরিপুষ্ট হলেও আইন এবং আইন প্রয়োগ ও চর্চায় দুর্বলতা ও ঘাটতি, আইনের অপব্যবহার এবং রাজনৈতিক বিবেচনায় আইনের প্রয়োগ প্রভৃতি কারণে লক্ষ্যগুলো অর্জনে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হচ্ছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) পরিচালিত ‘টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ১৬: দুর্নীতি প্রতিরোধ ও সুশাসন সংশ্লিষ্ট লক্ষ্যের ওপর বাংলাদেশের প্রস্তুতি, বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক এক গবেষণায় এই পর্যবেক্ষণ উঠে এসেছে। আজ সকালে টিআইবি’র ধানমন্ডিস্থ কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে গবেষণাটির প্রতিবেদন উপস্থাপনের সময় উপস্থিত ছিলেন টিআইবি’র ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা, নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের এবং গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান। গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন টিআইবি’র গবেষণা ও পলিসি বিভাগের সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার শাহজাদা এম আকরাম। এ সময় আরো উপস্থিত ছিলেন গবেষণা ও পলিসি বিভাগের সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার মো. ওয়াহিদ আলম এবং এ এস এম জুয়েল মিয়া।

টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) ১৬’র দুর্নীতি প্রতিরোধ ও সুশাসনের সাথে প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট চারটি লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশের প্রস্তুতি, বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জসমূহ পর্যালোচনার উদ্দেশ্যে গবেষণাটি এপ্রিল-আগস্ট ২০১৭ সময়ের মধ্যে পরিচালিত হয়।

গুণগত এ গবেষণায় তথ্যের পরোক্ষ উৎস হিসেবে সংশ্লিষ্ট আইন ও নীতি, গবেষণা প্রতিবেদন, আন্তর্জাতিক সূচক, দেশভিত্তিক ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিবেদন, জাতীয় তথ্যভা-ার ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন ব্যবহৃত হয়েছে। মুখ্য তথ্যদাতা হিসেবে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ, শিক্ষাবিদ, সরকারি কর্মকর্তা, পেশাজীবী ও সাংবাদিকদের সাক্ষাৎকার গৃহীত হয়।

গবেষণায় দেখা যায়, বিভিন্ন উদ্যোগ সত্ত্বেও বাংলাদেশে দুর্নীতি ও ঘুষ, অর্থপাচার, মৌলিক স্বাধীনতার ব্যত্যয় ও মানবাধিকার লঙ্ঘন অব্যাহত রয়েছে। জাতীয় শুদ্ধাচার কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো প্রত্যাশিত পর্যায়ে কার্যকর নয় এবং এজন্য দলীয় রাজনৈতিক প্রভাব, কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা, নির্বাহী বিভাগ ও প্রশাসনের আধিপত্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানেই জনগণের কাছে জবাবদিহিতার কোনো কাঠামো নেই এবং এসব প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ জবাবদিহিতা ব্যবস্থাও দুর্বল। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের স্বপ্রণোদিত তথ্য প্রকাশও পর্যাপ্ত নয়।

এছাড়া, দুর্নীতি প্রতিরোধ ও সুশাসনের সাথে সংশ্লিষ্ট অর্থপাচার এবং সম্পদ পুনরুদ্ধারসহ কয়েকটি বিষয়ে সরকারের কাছে আংশিক তথ্য থাকলেও দুর্নীতি ও ঘুষ, সরকারি সেবা ও প্রতিষ্ঠানের ওপর জনগণের সন্তুষ্টি এবং বিচার-বহির্ভূত হত্যাকা- বিষয়ে কোনো তথ্য নেই। সার্বিকভাবে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি)’র বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য ২৪১টি সূচকের মধ্যে সরকারের কাছে ৭০টি সূচকের ওপর সম্পূর্ণ এবং ১০৮টি সূচকের ওপর আংশিক তথ্য রয়েছে। ৬৩টি সূচকের ওপর সরকারি কোনো তথ্য নেই।

টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) ১৬’র দুর্নীতি প্রতিরোধ ও সুশাসনের সাথে প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট চারটি লক্ষ্যের মধ্যে অন্যতম হলো- ‘২০৩০ সালের মধ্যে অবৈধ অর্থ ও অস্ত্র প্রবাহ উল্লেখযোগ্য হারে কমানো, ব্যবহৃত সম্পদের পুনরুদ্ধার ও প্রত্যর্পণ প্রক্রিয়া শক্তিশালী করা এবং সকল প্রকার সংঘবদ্ধ অপরাধ মোকাবিলা করা’। গবেষণা অনুযায়ী, আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ থেকে অন্যদেশে এবং অন্যদেশ থেকে বাংলাদেশে অবৈধভাবে অর্থপাচারের পরিমাণ ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। গবেষণায় অর্থপাচার প্রতিরোধের ক্ষেত্রে চিহ্নিত প্রতিবন্ধকতাগুলোর মধ্যে রয়েছে জাতীয় ও খাতভিত্তিক ঝুঁকি পর্যালোচনায় ঘাটতি যেমন নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর রাজনীতিকরণ, দুর্নীতিতে রাজনৈতিক-প্রশাসনিক আঁতাত, সিকিউরিটিজ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বোর্ড সদস্য ও তাদের পরিবারের সদস্যদের রাজনীতির সাথে ত্রিমুখী সম্পৃক্ততা প্রভৃতি চিহ্নিত না করা; রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকের নির্বাহী কমিটি বা বোর্ডে রাজনৈতিক নিয়োগ চিহ্নিত না করা এবং অর্থপাচার সংক্রান্ত মামলার তদন্ত ও নিষ্পত্তিতে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা যেমন- রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর মামলার ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা, তদন্তের শুরুতে কার্যকরভাবে অর্থপাচার সংক্রান্ত অপরাধের তথ্য যাচাই না করা, অবৈধ অর্থের উৎস সন্ধান ও ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি; দুদক ও এনবিআর এর মতো নিয়ন্ত্রক ও তদারকি প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতার ঘাটতি ও নিজস্ব মামলা পরিচালনা ইউনিটের অনুপস্থিতি ইত্যাদি।

টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) ১৬’র অপর একটি লক্ষ্য- ‘সকল প্রকার দুর্নীতি ও ঘুষ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস করা’। গবেষণায় দেখা যায়, ঘুষ ও দুর্নীতি প্রতিরোধে যথেষ্ট আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো, কৌশল এবং অঙ্গীকার থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে দুর্নীতি ব্যাপকভাবে বিদ্যমান। সরকারি-বেসরকারি খাত ও প্রতিষ্ঠান থেকে সেবা নিতে গিয়ে সেবাগ্রহীতারা খানা পর্যায়ে বিপুল পরিমাণ দুর্নীতির শিকার হচ্ছেন। এছাড়াও দুর্নীতির ওপর একাধিক আন্তর্জাতিক সংস্থা পরিচালিত গবেষণায়ও বাংলাদেশকে উচ্চ-দুর্নীতিপ্রবণ দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বাংলাদেশে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণমূলক কার্যক্রম প্রত্যাশিত পর্যায়ের নয়।

তবে গবেষণায় সম্প্রতি দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রম বৃদ্ধির তথ্য পাওয়া গেছে। ২০১৬ সালে প্রাপ্ত ১২,৫৬৮টি অভিযোগের মধ্যে ১,৫৪৩টি অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য গৃহীত হয় এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বিভিন্ন বিভাগ ও মন্ত্রণালয়ে ৫৪৩টি অভিযোগ প্রেরণ করা হয়। এর আগে প্রতি বছর গড়ে ১,০২০টি অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য গৃহীত হতো। ২০১৬ সালে ৩৫৯টি অবৈধ উপায়ে সুবিধা লাভ সংক্রান্ত মামলা নথিভুক্ত করার পাশাপাশি ঘুষ নেওয়ার জন্য ১৩ জনকে আটক ও তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণসহ অবৈধ উপায়ে সুবিধা লাভ সংক্রান্ত বিভিন্ন মামলায় ৩৮৮ জনকে আটক করা হয়। এছাড়া, দুর্নীতির অভিযোগ জানানোর জন্য দুদক কর্তৃক সম্প্রতি হটলাইন চালু করা হয়েছে।

গবেষণায় দুর্নীতি ও ঘুষ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে যেসব চ্যালেঞ্জ পাওয়া গিয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব প্রকাশ সকলের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য না হওয়া; বিদ্যমান আইনে কয়েকটি বিভাগের কর্মচারীদের আওতামুক্ত রাখা; স্বার্থের দ্বন্দ্ব সংক্রান্ত প্রদত্ত বিবরণ প্রকাশে সরকারি কর্মচারীদের বাধ্যবাধকতা না থাকা; নির্বাচিত হওয়ার পর সংসদ সদস্যদের আর্থিক তথ্য প্রকাশের বাধ্যবাধকতা না থাকা; জনস্বার্থ সুরক্ষা সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রে পেশাগত বাধ্যবাধকতা, স্বার্থের দ্বন্দ্ব, তথ্য প্রকাশকারী কোনো সমস্যায় পড়লে তার প্রতিকার, অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য স্বচ্ছ, কার্যকর ও সময়োপযোগী পদ্ধতির অনুপস্থিতি; দরপত্রে অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানের বেনামী মালিকানার তথ্য প্রকাশের বাধ্যবাধকতা না থাক; সরকারি ক্রয়ে গোপন আঁতাত বন্ধ করার জন্য কোনো বিধান না থাকা; এবং সরকারি কর্মচারীদের জন্য অবসর গ্রহণের পর একই খাতের বেসরকারি কোনো চাকরিতে যোগদানের পূর্বে কতদিন ব্যবধান থাকতে হবে সে বিষয়ে কিছু উল্লেখ না থাকা।

টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) ১৬’র দুর্নীতি প্রতিরোধ ও সুশাসনের সাথে প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট আর একটি লক্ষ্য হলো- ‘সকল স্তরে কার্যকর, জবাবদিহিমূলক ও স্বচ্ছ প্রতিষ্ঠানের বিকাশ’। গবেষণায় দেখা যায়, বিভিন্ন আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো এবং উদ্যোগ গ্রহণ সত্ত্বেও এসডিজি ১৬’র এ লক্ষ্যটি অর্জনে সরকারের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে, কারণ এসব প্রতিষ্ঠান অনেক ক্ষেত্রেই প্রত্যাশিত পর্যায়ে কার্যকর, স্বচ্ছ ও দায়বদ্ধ হয়নি। প্রায় সকল সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নির্বাহী বিভাগের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। সরকার প্রধান এবং মন্ত্রিসভার সদস্যগণ নিজেদের সম্পদের বিবরণী প্রকাশ করেন না। মামলা জটের কারণে বিচার বিভাগের কার্যকরতা প্রত্যাশিত পর্যায়ে নেই। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো সেবা প্রদান, সম্পদ বরাদ্দ, ক্রয় ও বাস্তবায়নে কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল। এছাড়াও উপজেলা ও জেলা পরিষদ এখনো প্রত্যাশিত পর্যায়ে কার্যকর নয়। জনপ্রশাসনে সেবা প্রদান, সম্পদ বরাদ্দকরণ ও ক্রয়ের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীলতা বিদ্যমান।

গবেষণার পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, বিভিন্ন পর্যায়ে সরকারি কর্মচারী নিয়োগে দুর্নীতি হচ্ছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কার্যকরতাও প্রত্যাশিত পর্যায়ের নয়। গত দশ বছরে দেশে অপরাধ সংঘটনের হার প্রায় অপরিবর্তিত রয়েছে। এসব সংস্থার বিরুদ্ধে বিচার-বহির্ভূত হত্যা, বিনা বিচারে আটকে রাখা ও গুমের অভিযোগ থাকলেও বিচার বহির্ভূত হত্যা সম্পর্কে পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হয় না। গবেষণায় আরো দেখা যায়, সক্ষমতার সীমাবদ্ধতার কারণে মহা-হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক সকল সরকারি প্রতিষ্ঠানের নিরীক্ষা প্রতি বছর সম্পন্ন করতে পারে না। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ও তথ্য কমিশনের অনিষ্পন্ন অভিযোগের জট রয়েছে। প্রতিষ্ঠান দু’টিতে কমিশনারদের নিয়োগ প্রক্রিয়া অস্বচ্ছ। বাংলাদেশের কিছু গণমাধ্যম এবং নাগরিক সমাজ ও এনজিও খাতও অনেক ক্ষেত্রে প্রভাবান্বিত। আইনে বিদ্যমান ঘাটতির কারণে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কার্যকরতা, সচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে গবেষণায় চিহ্নিত করা হয়েছে। এছাড়া, দলীয় রাজনৈতিকসহ বিভিন্ন পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাব বিস্তার এবং বাজেট ও প্রশাসনিক জনবলের জন্য সরকারের ওপর নির্ভরশীলতার ফলে অনেক প্রতিষ্ঠানের কার্যকরতা প্রত্যাশিত পর্যায়ে নেই বলে পরিলক্ষিত হয়েছে।

গবেষণার অন্তর্ভুক্ত এসডিজি ১৬’র অন্যতম লক্ষ্য ‘জাতীয় আইন এবং আন্তর্জাতিক চুক্তির ভিত্তিতে তথ্য প্রাপ্তির অবাধ সুযোগ নিশ্চিতকরণ এবং মৌলিক স্বাধীনতার সুরক্ষাকরণ’। গবেষণা অনুযায়ী, যথাযথ আইনি কাঠামো থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে মৌলিক স্বাধীনতা খর্ব হওয়ার প্রবণতা বিদ্যমান। তথ্য অধিকার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, তথ্য অধিকারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্কোর এবং অবস্থান মধ্যম পর্যায়ের। এসডিজি’র এ লক্ষ্যটি অর্জনে সরকারের চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে রয়েছে জনগণের মৌলিক স্বাধীনতা লঙ্ঘনের ঘটনা সরকারের পক্ষ থেকে অস্বীকার করার প্রবণতা; এসব ঘটনার তদন্ত ও ফলাফল প্রকাশে সরকারের সদিচ্ছা ও স্বচ্ছতার ঘাটতি; তথ্য ও মত প্রকাশের ক্ষেত্রে কিছু আইনের কতিপয় ধারার অপব্যবহার; তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬ এর ৫৭ ধারার অপব্যবহার; এবং গণমাধ্যম বিষয়ক কয়েকটি খসড়া আইন ও নীতিমালার মাধ্যমে মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ ও বাধা-নিষেধ বৃদ্ধির আশঙ্কাজনক প্রবণতা।

ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘‘সার্বিকভাবে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ১৬ এর উল্লেখিত লক্ষ্যসমূহ পূরণে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সন্তোষজনক প্রস্তুতি ও সক্ষমতা রয়েছে বলে গবেষণায় প্রতীয়মান হলেও বিদ্যমান ঘাটতিসমূহ বিবেচনায় বাস্তবায়ন অবকাঠামো ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে উদ্বেগের বিষয়গুলো নিরসনে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে উদ্যোগ নিতে হবে।” এক্ষেত্রে অর্থপাচার প্রতিরোধ ও চুরি যাওয়া সম্পদ পুনরুদ্ধারে নিয়ন্ত্রক ও তদারকি প্রতিষ্ঠানসমূহের সক্ষমতার ঘাটতি, সকল পর্যায়ে দুর্নীতির বিস্তার রোধে প্রত্যাশিত মাত্রায় নিয়ন্ত্রণমূলক কার্যক্রমের অভাব এবং দলীয় রাজনীতির প্রভাবে অনেক প্রতিষ্ঠানের প্রত্যাশিত পর্যায়ে কার্যকরতা না থাকা উল্লেখযোগ্য বলে তিনি অভিমত প্রকাশ করেন। একই সাথে, জনগণের মৌলিক স্বাধীনতা লঙ্ঘনের ঘটনাসমূহ তদন্ত ও ফলাফল প্রকাশে সদিচ্ছা ও স্বচ্ছতার ঘাটতি এবং ব্যাংক খাতের সাম্প্রতিক দুর্নীতির ঘটনায় সম্পৃক্ত দোষীদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব সার্বিকভাবে অভীষ্ট ১৬ অর্জনের অগ্রগতির সাথে সাংঘর্ষিক বলে ড. জামান মনে করেন। এক্ষেত্রে এসডিজি’র মূল লক্ষ্য ‘কাউকে বাদ দিয়ে নয় ’- এর ওপর সবিশেষ গুরুত্ব প্রদানের জন্য ড. জামান আহ্বান জানান ।

গবেষণার ফলাফল ও সুপারিশের ওপর গুরুত্বারোপ করে ড. জামান বলেন, ‘‘টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনে সন্তোষজনক আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর পাশাপাশি সক্ষমতা ও প্রস্তুতি বিবেচনায় বাংলাদেশ সঠিক পথে রয়েছে, তবে গবেষণায় উদ্্ঘাটিত ঘাটতি ও উদ্বেগের বিষয়গুলো নিরসনে কার্যকর উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হলে অভীষ্ট অর্জনের পথ থেকে ছিটকে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।”

অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, ‘‘টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনের লক্ষ্যে নানামুখী পরিকল্পনা ও উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও বিভিন্ন জরিপ ও তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে এর সুফল সকল ক্ষেত্রে জনগণ পর্যন্ত পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না। এজন্য সকল পরিকল্পনা, কার্যক্রম ও কর্মসূচীতে জনগণকে সম্পৃক্ত করার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।” 
 
সংবাদ সম্মেলনে টিআইবি’র পক্ষ থেকে আইনি, প্রাতিষ্ঠানিক এবং প্রায়োগিক পর্যায়ে বাস্তবায়নের জন্য কিছু সুপারিশ উত্থাপন করা হয়। আইনি সুপারিশগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান ও সদস্যদের নিয়োগে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট যোগ্যতার মাপকাঠি নির্ধারণ এবং স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় নিয়োগ নিশ্চিতকরণ; সংবিধানের ৭০ ধারা সংশোধন করে কয়েকটি বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া সংসদ সদস্যদের নিজ দলের সিদ্ধান্তের বাইরে /বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার অনুমোদন দেওয়া; অধস্তন আদালতের ওপর আইন মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণমূলক ধারা বাতিলকরণ; সরকারি কর্মচারীদের স্বচ্ছতা, দায়বদ্ধতা, অধিকার ও দক্ষতা নিশ্চিতকরণে পাবলিক সার্ভিস আইন প্রণয়ন।

এছাড়াও পুলিশকে জনবান্ধব করার জন্য পুলিশ আইন ১৮৬১ সংস্কার এবং বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪ এর ৫৪ ধারা বাতিলকরণ; স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোতে স্থানীয় সংসদ সদস্যদের উপদেষ্টা করার বিধান রহিতকরণ; নির্বাচন কমিশন গঠন, কমিশনারদের প্রক্রিয়া ও কর্যক্রম বিষয়ে আইন প্রণয়ন করা; জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার বিরুদ্ধে উত্থাপিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের তদন্ত ও মামলা করার ক্ষমতা প্রদান; তথ্য অধিকার আইনে ব্যবসায়, রাজনৈতিক দল ও গণমাধ্যমকে অন্তর্ভুক্ত করা; তথ্য প্রযুক্তি আইন ২০১৩’র ৫৭ ধারা বাতিলকরণ; এবং বৈদেশিক অনুদান আইন ২০১৬’র ১৪ ধারার নিবর্তনমূলক অংশ বাতিলকরণ।

প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ের সুপারিশগুলোতে দুর্নীতি প্রতিরোধ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সহায়ক সংস্থাগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক ও আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধির সুপারিশের পাশাপাশি অর্থপাচার প্রতিরোধে প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধির সুপারিশসহ তাদের স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করার জন্য ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রণোদনা প্রদানের সুপারিশ করা হয়। প্রায়োগিক পর্যায়ের সুপারিশ হিসেবে জাতীয় শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি জনগণের আস্থা, সন্তুষ্টি  এবং ঘুষ ও দুনীতির অভিজ্ঞতা বিষয়ে দেশব্যাপী বেজলাইন জরিপ পরিচালনার সুপারিশ করা হয়। এছাড়া, এসডিজি ১৬ কে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে লক্ষ্যভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন; দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ; দুর্নীতির মামলার দ্রুত নিষ্পত্তিকরণ; এবং স্বচ্ছ ক্রয় প্রক্রিয়া নিশ্চিতকরণসহ সকল প্রকার বিচার-বহির্ভূত হত্যাকা-ের অভিযোগ তদন্তের জন্য বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠনের সুপারিশ করা হয়।
 
গণমাধ্যম যোগাযোগ,
 
রিজওয়ান-উল-আলম
পরিচালক, আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগ
মোবাইল: ০১৭১৩০৬৫০১২
ই-মেইল: rezwan@ti-bangladesh.org
 

Press Release