পাসপোর্ট সেবায় সুশাসন নিশ্চিতে টিআইবি’র ১২ দফা সুপারিশ জনবল ও অবকাঠামো নিশ্চিতসহ সত্যায়ন, প্রত্যয়ন ও পুলিশ প্রতিবেদনের বিধান বাতিলের তাগিদ

সংবাদ বিজ্ঞপ্তি

পাসপোর্ট সেবায় সুশাসন নিশ্চিতে টিআইবি’র ১২ দফা সুপারিশ
জনবল ও অবকাঠামো নিশ্চিতসহ সত্যায়ন, প্রত্যয়ন ও পুলিশ প্রতিবেদনের বিধান বাতিলের তাগিদ

 

ঢাকা, ২১ আগস্ট ২০১৭: পাসপোর্ট প্রক্রিয়াকরণের বিভিন্ন ধাপে বিদ্যমান অনিয়ম ও দুর্নীতিসমূহ চিহ্নিতকরণের পাশাপাশি এ খাতের সুশাসন নিশ্চিতে দেশের পাসপোর্ট কার্যালয়সমূহে প্রয়োজনীয় জনবল, অবকাঠামো ও লজিস্টিকসের সরবরাহ নিশ্চিতকরণ, আবেদনপত্র সত্যায়ন, প্রত্যয়ন ও পুলিশ প্রতিবেদনের বিধান বাতিল এবং দালালের দৌরাত্ম নিমূর্লসহ বার দফা সুপারিশ উত্থাপন করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। আজ সংস্থার ধানমন্ডিস্থ কার্যালয়ে “পাসপোর্ট সেবায় সুশাসন: চ্যালেঞ্জ ও করণীয়” শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনের প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ সংক্রান্ত সুপারিশ উপস্থাপন করেন টিআইবি’র গবেষণা ও পলিসি বিভাগের প্রোগ্রাম ম্যানেজার মো. শাহনূর রহমান। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবি’র ট্রাস্টি বোর্ডের  চেয়ারপরসন অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, সদস্য এম. হাফিজউদ্দিন খান, নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের এবং গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান।

আলোচ্য গবেষণায় দেশব্যাপী মোট ১৪৫৩ জন সেবাগ্রহীতার ওপর পরিচালিত একটি প্রতিনিধিত্বশীল জরিপ ছাড়াও, মুখ্য তথ্যদাতার সাক্ষাৎকার, নিবিড় সাক্ষাৎকার, দলগত আলোচনা, কেস স্টাডি ও পর্যবেক্ষণ পদ্ধতিসহ পাসপোর্ট সেবা বিষয়ক প্রবন্ধ, গবেষণা প্রতিবেদন, গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ বিশ্লেষণ ও সংশ্লিষ্ট নথি পর্যালোচনা করা হয়েছে। সেপ্টেম্বর ২০১৬ থেকে মে ২০১৭ সময়ের মধ্যে এই গবেষণা কার্যক্রমটি পরিচালিত হয়। সেবাগ্রহীতা জরিপটি ৮ নভেম্বর থেকে ১৫ ডিসেম্বর সময়ের মধ্যে সম্পাদিত হয়।

গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী পাসপোর্ট সেবাকে জনমুখী ও সহজীকরণে সাম্প্রতিককালে (২০১৫-২০১৬) অধিদপ্তর বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল: পাসপোর্ট অফিসগুলোর একাংশের হেল্প ডেস্কের মাধ্যমে সেবা প্রদান, সেবাগ্রহীতাদের অভিযোগ নিরসনে ও সেবার মান বৃদ্ধিকরণে আঞ্চলিক অফিসসমূহে গণশুনানীর ব্যবস্থা গ্রহণ, অভিযোগ বাক্স স্থাপন, কয়েকটি পাসপোর্ট অফিসে সেবাগ্রহীতাদের সুপারিশ ও সন্তুষ্টি জানতে ক্লায়েন্ট স্যাটিসফেকশন রেজিস্টার প্রবর্তন, পাসপোর্ট বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতে পাসপোর্ট সেবা সপ্তাহ উদযাপন, উন্নত সেবা প্রদানে উৎসাহিত করার জন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কর্মকর্তা-কর্মচারী পুরস্কারের ব্যবস্থা, কয়েকটি অফিসে স্বতন্ত্র ফেসবুক আইডি খোলা এবং ফেসবুক পেজের মাধ্যমে অভিযোগ গ্রহণ ও তা নিষ্পত্তি প্রক্রিয়া চালুকরণ উল্লেখযোগ্য। এছাড়া বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিস, সিলেট কর্তৃক গৃহীত কিছু উদ্যোগ সকল পাসপোর্ট অফিসের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

পাসপোর্ট সেবায় বিদ্যমান অনিয়ম, হয়রানি ও দুর্নীতি চিহ্নিত করে গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয় যে, জরিপের অন্তর্ভুক্ত সেবাগ্রহীতাদের ৫৫.২% পাসপোর্ট সেবায় অনিয়ম, হয়রানি ও দুর্নীতির শিকার হয়েছে (অনিয়ম ও দুর্নীতিসমূহ পাসপোর্ট সেবার যে সকল স্তরে সংগঠিত হয় তার মধ্যে রয়েছে আবেদনপত্র উত্তোলন, আবেদনপত্র জমাদান ও প্রি-এনরোলমেন্ট, বায়ো-এনরোলমেন্ট, পাসপোর্ট বিতরণ এবং দালালের সাথে চুক্তি)। পাসপোর্ট অফিসের সেবায় ঘুষ বা নিয়ম-বর্হিভূত অর্থ দেওয়ার গড় পরিমান ২,২২১ টাকা। নতুন পাসপোর্ট আবেদনে সেবাগ্রহীতাদের ৭৬.২% পুলিশী তদন্তে অনিয়ম ও দুর্নীতির শিকার এবং ৭৫.৩% সেবাগ্রহীতাকে ঘুষ বা নিয়ম-বর্হিভূত অর্থ দিতে হয়েছে। এছাড়া, ঘুষ বা নিয়ম-বর্হিভূত অর্থ হিসেবে গড়ে ৭৯৭ টাকা দিতে হয়েছে। পুলিশ প্রতিবেদন প্রণয়নে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি) কর্তৃক আবেদনপত্রে অযথা ত্রুটি খুঁজে বের করার চেষ্টা, জঙ্গি কার্যক্রম বা অন্য রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ততার ভয় দেখানো, বাড়িতে না এসে চায়ের দোকান বা থানায় ডেকে পাঠানো, নিয়ম-বর্হিভূত অর্থ বা ঘুষ দাবি করা এবং ক্ষেত্রবিশেষে তা বিকাশে পাঠাতে বলার মাধ্যমে আবেদনকারীদের হয়রানি করার বিভিন্ন অভিযোগ উঠে এসেছে গবেষণা প্রতিবেদনে। এছাড়া, পাসপোর্ট বিতরণে অফিস নির্ধারিত সময়ের পর গড়ে ১২ দিন, সর্বোচ্চ ৪৪.৮ দিন এবং সর্বনিম্ন ৪.৪ দিন বিলম্ব হয়।

গবেষণা অনুযায়ী জরিপের আওতাভুক্ত প্রায় সকল পাসপোর্ট অফিসেই (অভ্যন্তরে ও বাইরে) দালালের উপস্থিতি লক্ষণীয়। দালালদের একাংশ এসবি পুলিশ এবং পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একাংশের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে। দালালদের একাংশ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় তাদের দৌরাত্ম্য বজায় রাখে। আবেদনকারীদের ৪১.৭% দালাল বা অন্যের সহযোগিতা নিয়েছেন; তাদের মধ্যে ৮০% দালালের সহযোগিতা নিয়েছেন। দীর্ঘ লাইন, বার বার আসা ইত্যাদি এড়িয়ে চলা; নিয়ম-কানুন সম্পর্কে না জানা; দালালের সহযোগিতা ছাড়া আবেদনপত্র জমা দিলে কর্তৃপক্ষের জমা না নেয়া; নির্ধারিত সময়ের পূর্বে পাসপোর্ট পাওয়ার জন্য; নির্ধারিত সময়ের পূর্বে পাসপোর্ট পাওয়ার জন্য এবং সময়ের অভাব দালালের সহযোগিতা গ্রহণের কারণ হিসেবে গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হেেয়ছে। দালালদের সহযোগিতা নিয়েছেন এমন সেবাগ্রহীতাদের ২১.৬% বলেছেন যে, দালালের সহযোগিতা না নিলে কর্তৃপক্ষ আবেদনপত্র জমা নেয় না। এছাড়া, সেবাগ্রহীতাদের মধ্যে যারা দালালের সহযোগিতা নিয়েছেন তাদের ৭৫.১% এবং যারা সহযোগিতা নেয়নি তাদের ৭২.২% সময়মত পাসপোর্ট পেয়েছেন। যদিও দালালরা নির্ধারিত সময়ের আগে পাসপোর্ট করিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিতে সেবাগ্রহীতাদের কাছ থেকে অর্থ নেন কিন্তু গবেষণায় সে ব্যাপারে তাৎপর্যপূর্ণ সম্পর্ক পাওয়া যায়নি।

ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “সম্প্রতি পাসপোর্ট সেবায় ইতিবাচক কিছু পরিবর্তন সাধিত হলেও সেবার মান এখনো প্রত্যাশিত পর্যায়ে পৌঁছায়নি। পাসপোর্ট অফিসগুলোতে দালালচক্র এখনো সক্রিয়। এ ছাড়া পুলিশ ভেরিফিকেশন এবং আবেদন ফরম সত্যায়ন করতে সেবাগ্রহীতারা হয়রানির শিকার হচ্ছে।” কোনো প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও পুলিশ ভেরিফিকেশন ও আবেদনত্র সত্যায়নের নিয়ম চালু রেখে সেবাগ্রহীতাদের হয়রানি করা হচ্ছে বলে মন্তব্য করে ড. জামান এ নিয়ম দু’টি বন্ধ করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।

সুলতানা কামাল বলেন, “পাসপোর্ট কার্যালয়গুলোর ভেতরের কিছু কর্মকর্তাদের প্রশ্রয় না থাকলে দালালদের দৌরাত্ম থাকত না।” তিনি আরো বলেন, “পাসপোর্ট খাতে অনিয়মের সবচেয়ে বড় কারণ হলো সাধারণ মানুষের অভিগম্যতায় বিভিন্ন ধরণের প্রতিবন্ধকতা।” পুলিশ ভেরিফিকেশন ও আবেদন ফরম সত্যায়নের বিধানটি রাষ্ট্র ও জনগণের মধ্যে বিশ্বাসহীনতার একটি ঔপনিবেশিক সংস্কৃতিরই বহি:প্রকাশ বলে তিনি অভিমত প্রকাশ করেন।

গবেষণা প্রতিবেদনে উপস্থাপিত সুপারিশসমূহের উল্লেখযোগ্য হল: পাসপোর্টের আবেদনপত্র পূরণ আরও ব্যবহার-বান্ধব এবং ফি জমা দেওয়ার ক্ষেত্রে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের অন্তর্ভুক্তি; আবেদনপত্র পূরণের নিয়মাবলী এবং সেবা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন তথ্য নির্দেশিকা ও সর্বাধিক জিজ্ঞাসিত প্রশ্নসমূহের উত্তর অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে প্রকাশ এবং বিনামূল্যে বিতরণ; বিদ্যমান পুলিশ প্রতিবেদন সংক্রান্ত জটিলতা নিরসনে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের সাথে মাসিক ভিত্তিতে সমন্বয় সভা আয়োজন এবং পাসপোর্ট বিতরণে বিলম্ব এড়াতে নির্ধারিত তারিখের পূর্বে যৌক্তিক কারণসহ এসএমএস-এর মাধ্যমে অবহিতকরণ। এছাড়া, পাসপোর্ট অফিস ও এসবি পুলিশের যেসব অসাধু কর্মচারীদের যোগসাজশে দালালচক্র তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রাখছে তাদেরকে শাস্তির আওতায় আনা এবং দালালের সহযোগিতা নেওয়ার বিরুদ্ধে প্রচারণা এবং পাসপোর্ট অফিসের কর্মচারীদের অফিস সময়ে নির্ধারিত পোশাকের ব্যবস্থা এবং পরিচয়পত্র ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার সুপারিশ করা হয়। পাসপোর্ট ইস্যুর ক্ষেত্রে পুলিশ ভেরিফিকেশনের বিধান বাতিল এবং সকল নাগরিকের জন্য ‘বায়োমেট্রিক ডাটা ব্যাংক’ তৈরির পাশাপাশি স্মার্ট কার্ড তৈরি ও বিতরণ, ‘অপরাধী তথ্যভান্ডার’ আধুনিক ও যুগোপযোগী করে এই তথ্য ভান্ডারের সাথে পাসপোর্ট অফিস ও ইমিগ্রেশন চেকপোস্টের সংযোগ স্থাপন; নাগরিক সংগঠনগুলোর সম্পৃক্ততায় সেবার মান যাচাই ও উন্নতিকল্পে নির্দিষ্ট সময় অন্তর মূল্যায়ন ব্যবস্থার প্রবর্তন; চাহিদার সাথে সংগতি রেখে পাসপোর্ট কার্যালয়গুলোতে জনবল, অবকাঠামো ও লজিস্টিকসের সরবরাহ ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতকরণ; পাসপোর্ট আবেদনে প্রি-এনরোলমেন্ট ও বায়ো-এনরোলমেন্টের তথ্যাদি ব্যবহারে জাতীয় পরিচয়পত্র (স্মার্ট কার্ড) সংরক্ষিত তথ্য ব্যবহার পর্যায়ক্রমে শুরু এবং পাসপোর্টের মেয়াদ পাচঁ বছরের পরিবর্তে দশ বছর করার সুপারিশ করা হয়।

 

গণমাধ্যম যোগাযোগ:

 

রিজওয়ান-উল-আলম
পরিচালক, আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন
ফোন: ০১৭১৩ ০৬৫০১২
ই-মেইল:rezwan@ti-bangladesh.org  
 

Press Release