সেবা খাতে দুর্নীতি: জাতীয় খানা জরিপ ২০১৫ প্রকাশ
৬৮ শতাংশ খানা দুর্নীতির শিকার; ঘুষের শিকার হবার হার ২০১২ তুলনায় ছয় শতাংশ বৃদ্ধি
ঢাকা, ২৯ জুন ২০১৬: ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)কর্তৃক পরিচালিত ‘সেবাখাতে দুর্নীতি: জাতীয় খানা জরিপ ২০১৫’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৫ সালে সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ৬৭.৮% খানা দুর্নীতির শিকার হয়েছে; ৫৮.১% খানাকে ঘুষ দিতে হয়েছে। খানা প্রতি বাৎসরিক গড় ঘুষের পরিমাণ ৪,৫৩৮ টাকা। ২০১৫ সালে বিভিন্ন সেবা খাতে দুর্নীতি ও হয়রানির হার ২০১২ তুলনায় প্রায় অপরিবর্তিত (৬৭.৮% বনাম ৬৭.৩%) থাকলেও সেবাগ্রহণকারী খানা সমূহকে ২০১২ সালের তুলনায় প্রায় ১৫০০ কোটি টাকা বেশি প্রদান করতে হয়েছে। জরিপে সেবাগ্রহণের প্রেক্ষিতে সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত খাতগুলো যথাক্রমে পাসপোর্ট (৭৭.৭%), আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা (৭৪.৬%) শিক্ষা (সরকারি ও এমপিওভুক্ত) (৬০.৮%), বিআরটিএ (৬০.১%), ভূমি প্রশাসন (৫৩.৪%), বিচারিক সেবা (৪৮.২%)ও স্বাস্থ্য (৩৭.৫%)। বিভিন্ন খাতে সেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে নিম্ন আয়ের জনগণের ওপর ঘুষ তথা দুর্নীতির বোঝা অধিক। জরিপে অন্তর্ভুক্ত প্রায় ৭১% খানা ঘুষ বা নিয়ম বর্হিভূত অর্থ প্রদানের মূল কারণ হিসেবে ‘ঘুষ না দিলে কাঙ্ক্ষিত সেবা পাওয়া যায় না’ এই কারণটিকে চিহ্নিত করেছেন।
আজ সকালে সংস্থাটির ধানমন্ডিস্থ কার্যালয়ে ‘সেবা খাতে দুর্নীতি: জাতীয় খানা জরিপ ২০১৫’ প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে জরিপের ফলাফল তুলে ধরে টিআইবি জানায় জাতীয়ভাবে প্রক্কলিত মোট ঘুষ বা নিয়ম বর্হিভূত অর্থের পরিমাণ ৮৮২১.৮ কোটি টাকা। এই প্রাক্কলিত অর্থের পরিমান ২০১৪-১৫ অর্থ বছরের বাংলাদেশের জিডিপি’র ০.৬% এবং জাতীয় বাজেটের (সংশোধিত) ৩.৭%। সংবাদ সম্মেলনে মূল প্রতিবেদনের সারাংশ উপস্থাপন করেন টিআইবি’র গবেষণা ও পলিসি বিভাগের সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার মো. ওয়াহিদ আলম, প্রোগ্রাম ম্যানেজার ফারহানা রহমান ও ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার মোহাম্মদ নূরে আলম। টিআইবি ট্রাস্টি বোর্ড চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল এর সভাপতিত্বে সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপ-নির্বাহী পরিচালক ড. সুমাইয়া খায়ের এবং রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো’র কমিউনিটি সিরিজের এর আলোকে নমুনা কাঠামো তৈরি করে তিন পর্যায় বিশিষ্ট স্তরায়িত গুচ্ছ নমুনায়ন পদ্ধতিতে জরিপটি পরিচালিত হয়। নভেম্বর ২০১৪ থেকে অক্টেবর ২০১৫ পর্যন্ত খানাসমূহ ১৫টি প্রধান ও অন্যান্য খাতে যেসকল সেবা গ্রহণ করেছে তার উপর ভিত্তি করে ১ নভেম্বর থেকে ২৫ ডিসেম্বর ২০১৫ পর্যন্ত জরিপের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। জরিপের বৈজ্ঞানিক মান নিশ্চিত করতে বিভিন্ন পর্যায়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পাঁচজন বিশেষজ্ঞের সার্বিক সহায়তা ও পরামর্শ গ্রহণ করা হয়েছে। পল্লি এলাকায় ৭০% এবং শহর এলাকায় ৩০% নমুনা বিবেচনায় ও ৬৪টি জেলা ও ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনকে স্তর বিবেচনায় প্রতি স্তরে দৈবচয়নের মাধ্যমে ২৪০টি খানা নির্বাচন করা হয়। জরিপের আওতাভুক্ত মোট ১৫৮৪০টি খানার মধ্যে ১৫,২০৬টি খানা থেকে তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়, যার মধ্যে গ্রামাঞ্চলে ১০,৭৪৩টি (৭০.৬%) শহরাঞ্চলে ৪,৪৬৩টি (২৯.৪%)।
দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় গুরুত্ব ও প্রভাব বিবেচনায় নিয়ে ১৫টি প্রধান খাতকে জরিপে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। খাতসমূহের মধ্যে রয়েছে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, ভূমি প্রশাসন, কৃষি, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, বিচারিক সেবা, বিদ্যুৎ, ব্যাংকিং, কর ও শুল্ক, এনজিও, পাসপোর্ট, গ্যাস, বিআরটিএ, বীমা। এছাড়া তথ্য প্রদানকারীরা এর অতিরিক্ত যে সকল খাত উপ-খাতের তথ্য প্রদান করেন সেগুলো ‘অন্যান্য’ (ওয়াসা, বিটিসিএল, ডাক ইত্যাদি) হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
জাতীয় খানা জরিপের সার্বিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৫ সালে সেবা খাতে ঘুষের শিকার হওয়ার হার ২০১২ সালের তুলনায় সার্বিকভাবে বেড়েছে (৫৮.১% বনাম ৫১.৮%)। তবে সার্বিকভাবে অনিয়ম দুর্নীতির হার প্রায় অপরিবর্তিত রয়েছে। ২০১২ সালের তুলনায় ২০১৫ সালে ভূমি প্রশাসন, বিচারিক সেবা, স্বাস্থ্য, ব্যাংকিং, এনজিও ও অন্যান্য খাতে দুর্নীতি উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। কিন্তু স্থানীয় সরকার, বিদ্যুৎ ও বীমা খাতে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। শিক্ষা, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, কৃষি, কর ও শুল্ক খাতে দুর্নীতির হার প্রায় অপরিবর্তিত আছে। এছাড়া স্বাস্থ্য, বিচারিক সেবা, ভূমি প্রশাসন সহ মোট ৬টি খাতে ঘুষের শিকার খানার হার ২০১২ এর তুলনায় কমেছে। তবে শিক্ষা, বিদ্যুৎ এবং এনজিও এর ক্ষেত্রে এই হার বেড়েছে। ঘুষের হার অপরিবর্তিত রয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, কৃষি, কর ও শুল্ক ও অন্যান্য খাত। শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামঞ্চলে সেবা খাতে দুর্নীতির প্রকোপ বেশি (৬২.৬% বনাম ৬৯.৫%)। অনুরূপভাবে, শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামঞ্চলে ঘুষ প্রদানে বাধ্য হবার হারও বেশি (৫৩.৪% বনাম ৫৯.৬%)।
উল্লেখ্য, সেবামূলক খাত বা প্রতিষ্ঠান হতে বিভিন্ন ধরনের সেবা গ্রহণে কোনো দুর্নীতির শিকার হয়েছে কিনা তা চিহ্নিত করার পাশাপাশি খানাগুলো সেবা নিতে গিয়ে যে দুর্নীতি বা হয়রানির শিকার হয় তার প্রকৃতি ও মাত্রা নিরূপণ করা এবং দুর্নীতি প্রতিরোধে ও নিয়ন্ত্রণে দিক-নির্দেশনামূলক সুপারিশ প্রদান করাই এই জরিপের উদ্দেশ্য। ১৯৯৭ সাল থেকে টিআইবি এ পর্যন্ত ৭টি খানা জরিপ পরিচালনা করেছে।
টিআইবি ট্রাস্টি বোর্ড চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, “দুর্নীতি হল নৈতিকতার ওপর হামলা স্বরূপ, অন্যদিকে ঘুষ যেন প্রাত্যহিক জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে। প্রত্যেকেই কোনো না কোনো ভাবে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। এখানেই আমাদের সবচেয়ে বড় উদ্বেগ। যিনি সেবার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকেন তার কাছ থেকে ঘুষ ছাড়া সেবা প্রাপ্তি সম্ভবপর হয় না। যারা এই ধরনের দায়িত্বে নিয়োজিত থাকেন তারা নৈতিকতা এবং দায়বদ্ধতার সাথে তাদের দায়িত্ব পালন করছেন না। যার ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ জনগণ, বিশেষ করে যাদের পক্ষে কথা বলার কেউ নেই। তাই দুর্নীতির দুষ্টচক্র থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে।’’
সংবাদ সম্মেলনে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘‘ঘুষ ছাড়া সেবা প্রাপ্তি এখন প্রায় দুরূহ। জনগণের মৌলিক অধিকার, দৈনন্দিন জীবন যাপন ও আর্থ সামাজিক কর্মকান্ডের জন্য অপরিহার্য যে খাতগুলো এবং যেসব খাতের উপর দুর্নীতি প্রতিরোধ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা নির্ভরশীল বিশেষ করে পাসপোর্ট সেবা, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, শিক্ষা (সরকারি ও এমপিওভুক্ত), বিআরটিএ, ভূমি প্রশাসন, বিচারিক সেবা, স্বাস্থ্য এবং স্থানীয় সরকারের মত খাতে দুর্নীতির প্রভাব ও ঘুষ লেনদেনের অভিজ্ঞতা এখনো সবচেয়ে বেশি। তাই ব্যাষ্টিক পর্যায়ে সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে দুর্নীতি হ্রাসের প্রবণতাকে এগিয়ে নিতে আইনের বাস্তব, প্রভাবমুক্ত ও কঠোর প্রয়োগ এবং তথ্যের অভিগম্যতা বৃদ্ধিসহ সকল পর্যায়ে গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। দুর্নীতি যে পর্যায়েই হোক আর এর সাথে যারাই সম্পৃক্ত থাকুক না কেন, কারও প্রতি করুণা বা ভয় না করে যথাযথ আইনী প্রক্রিয়া অনুসরণপূর্বক দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা না হলে দুর্নীতি প্রতিরোধে সরকারের অঙ্গীকার বাস্তবায়ন অসম্ভব।’’
প্রশ্নোত্তর পর্বে ড. জামান দুর্নীতিকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে প্রমানে দুর্নীতির মাধ্যমে লাভবানদের বিচারের আওতায় আনা, রাজনৈতিক সদিচ্ছার বাস্তবায়ন এবং জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলের আওতাভুক্ত প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার দায়িত্বে নিয়োজিত সংস্থাসমূহের কার্যকর ভূমিকার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
সার্বিকভাবে জাতীয় খানা জরিপ ২০১৫ এ বেশকিছু সুপারিশ প্রদান করা হয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হলো - দুর্নীতিকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে বিভিন্ন খাতে দুর্নীতির সাথে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিদ্যমান আইনের আওতায় আনা; সেবাখাতে দুর্নীতি প্রতিরোধে বিভাগীয় পদক্ষেপের পাশাপাশি প্রযোজ্য ক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) ব্যবস্থা গ্রহণ করা; প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলের সাথে সামঞ্জস্য রেখে সুদৃঢ় নৈতিক আচরণবিধি প্রণয়ন ও প্রয়োগ করা এবং এর ভিত্তিতে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা; এছাড়াও সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সেবা প্রদানে স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ এবং সেবাগ্রহীতা ও সেবাপ্রদানকারীর মধ্যে সংযোগ বৃদ্ধিসহ গণশুনানির আয়োজন করা; বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সেবাদানের সাথে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মকাণ্ডের মূল্যায়নের ভিত্তিতে পুরস্কার ও তিরস্কার বা শাস্তির ব্যবস্থা করা; দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনগণের সচেতনতা ও অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য সামাজিক আন্দোলন জোরদার করা এবং একইসাথে এক্ষেত্রে গণমাধ্যমে সক্রিয়তা বৃদ্ধি করার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়; সার্বিকভাবে সেবাগ্রহীতার সাথে সেবাদাতার প্রত্যক্ষ যোগাযোগ হ্রাসে তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো; জনগণের সেবা সম্পর্কিত তথ্যে অভিগম্যতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সেবা খাতে অনলাইনে স্বপ্রণোদিত তথ্য প্রকাশ বৃদ্ধি করা; বিভিন্ন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের দক্ষতা বাড়াতে দুর্নীতিবিরোধী আইন, তথ্য অধিকার আইন ও বিশেষ করে তথ্য প্রকাশকারীর সুরক্ষা আইনের ওপর প্রশিক্ষণ দেয়া; ‘তথ্য অধিকার আইন ২০০৯’ কার্যকর বাস্তবায়ন করা ও ‘তথ্য প্রকাশকারীর সুরক্ষা আইন ২০১১’ এর প্রয়োগে প্রচারণা ও প্রণোদনাসহ বাস্তব পদক্ষেপ নেয়া; সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানে অপ্রয়োজনীয় ধাপ ও অন্যান্য বাধা দূর করতে পদ্ধতিগত সংস্কার করা; জনবল, অবকাঠামো ও লজিস্টিকস এর ঘাটতি দূরীকরণে সেবাখাতগুলোতে আর্থিক বরাদ্দ বাড়ানোর পাশাপাশি এদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা ইত্যাদি।
Corruption in Service Sectors: National Household Survey 2015