ঢাকা, ২১ এপ্রিল ২০১৬ :২০১৩ সালে সংঘটিত রানা প্লাজা ট্রাজেডি-উত্তর পোশাক খাতের সুশাসন নিশ্চিতকরণে সরকার ও বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারের বহুমুখী উদ্যোগসমূহ ২০১৬ পর্যন্ত ৩৯ শতাংশ সম্পূর্ন বাস্তবায়ন এবং ৩৮ শতাংশ বাস্তবায়নে সন্তোষজনক অগ্রগতি অর্জিত হলেও অনেক উদ্যোগ বিভিন্ন কারণে এখনো প্রত্যাশিত অগ্রগতি অর্জন করতে না পারায় পোশাক খাতের বিদ্যমান বিবিধ চ্যালেঞ্জ থেকে উত্তরণে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) সরকারের কাছে দশ-দফা সুপারিশ উপস্থাপন করেছে।
আজ সকালে ধানমন্ডিস্থ কার্যালয়ে “তৈরি পোশাক খাতে সুশাসন: অগ্রগতি, চ্যালেঞ্জ ও করণীয়” শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষ্যে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এই অভিমত ব্যক্ত করে টিআইবি জানায় ২০১৩ সাল থেকে সূচকে গৃহিত ১০২টি উদ্যোগের মধ্যে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ৭৭% উদ্যোগের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অর্জন সম্ভব হয়েছে তবে অবশিষ্ট ২৩% উদ্যোগের ক্ষেত্রে ধীরগতি এবং কোন কোন ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন স্থবির হয়ে পড়ায় পোশাক খাতে সার্বিক সুশাসন অর্জনে সকল পক্ষের সম্মিলিত ও সমন্বিত প্রয়াস গ্রহণ জরুরি হয়ে পড়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন টিআইবি’র রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি বিভাগের প্রোগ্রাম ম্যানেজার মনজুর ই খোদা। অনুষ্ঠানে আরোও উপস্থিত ছিলেন টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপ-নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান এবং সহকারী প্রোগ্রাম ম্যানেজার নাজমুল হুদা মিনা।
রানাপ্লাজা ট্রাজেডি-উত্তর পোশাক খাতের সুশাসন নিশ্চিতকরণে সরকার ও বিভিন্ন অংশীজন বহুমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করে। এ সকল উদ্যোগের বাস্তবায়নের অগ্রগতি ও চ্যালেঞ্জ পর্যালোচনায় টিআইবি ধারাবাহিকভাবে গবেষণা পরিচালনা করে আসছে। ২০১৩ সালে পরিচালিত টিআইবি’র ‘তৈরি পোশাক খাত: সুশাসনের সমস্যা ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনের তৃতীয় ফলোআপ হিসেবে বর্তমান গবেষণাটি ২০১৫ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৬ সালের মার্চ পর্যন্ত পরিচালিত হয়। গত এক বছরের পর্যালোচনায় দেখা যায় চলমান ৬৮টি উদ্যোগের ক্ষেত্রে ৬টি উদ্যোগ সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে, ৩৯টি উদ্যোগ বাস্তবায়নে সন্তোষজনক অগ্রগতি, ১০টি উদ্যোগ বাস্তবায়নে ধীর গতিসম্পন্ন এবং ১৩টি উদ্যোগ বাস্তবায়নে স্থবিরতা পরিলক্ষিত হয়।
সুশাসনের অন্তরায় দূরীকরণে ২০১৬ পর্যন্ত সরকারের গৃহিত উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপসমূহ হচ্ছে: ইপিজেড শ্রম আইন ২০১৬ মন্ত্রিসভায় নীতিগত অনুমোদন, ইপিজেড শ্রমিকদের আইনগত সুবিধা প্রদানে ইপিজেড শ্রম আদালত ও শ্রম আপিলেট ট্রাইব্যুনাল গঠন, এবং শ্রম বিধিমালা-২০১৫ পাশ। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি প্রায় ৯৫ শতাংশ কারখানায় ন্যূনতম মজুরি বোর্ড কর্তৃক নির্ধারিত হারে মজুরি দেওয়া হচ্ছে, এবং অধিকাংশ কমপ্লায়েন্স কারখানায় শ্রমিকদের জরুরি নম্বরসহ পরিচয়পত্র দেওয়া হচ্ছে। বিজিএমইএ শ্রমিকদের দক্ষতা উন্নয়নে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট এর ‘সিপ’ প্রজেক্টের আওতায় ৪৩৮০০ জন শ্রমিককে প্রশিক্ষণ ও প্রশিক্ষণ পরবর্তী চাকুরির ব্যবস্থা চলমান এবং ওয়ার্ল্ড ব্যাংক এর ‘স্টেপ’ ও ‘নারী’ প্রজেক্টের আওতায় ট্রেনিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে এবং নিয়মিত অগ্নি নিরাপত্তা বিষয়ে ক্র্যাশ কোর্স পরিচালনা করছে। সেইসাথে কারখানা শ্রমিকদের সমন্বিত ডাটাবেজ গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ইউরোপের বায়ারদের জোট অ্যাকর্ড ও মার্কিন বায়ারদের জোট অ্যালায়েন্স কারখানার অগ্নি, বৈদ্যুতিক ও কাঠামোগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রায় শতভাগ কারখানায় জরিপ সম্পন্ন করেছে এবং জরিপ পরবর্তী রেমেডিয়েশনের ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি (প্রায় ৪৪%) সাধিত হয়েছে। এছাড়া রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের সহায়তার উদ্দেশ্যে গঠিত বিভিন্ন তহবিল থেকে প্রায় ৩০ মিলিয়ন ইউএস ডলার সফলভাবে বিতরণ করা হয়েছে।
গবেষণায় আরোও দেখা যায় বিভিন্ন অংশীজন কর্তৃক গৃহীত বিভিন্ন উদ্যোগ বাস্তবায়নে ইতিবাচক অগ্রগতি সত্ত্বেও এখনও বিভিন্ন রকম চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান। শ্রম আইনের বিভিন্ন ধারার [(২৩, ২৭, ১৮৯, ২(৬৫)] অপব্যবহারের মাধ্যমে শ্রমিকদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত ইপিজেড শ্রম আইন ২০১৬ এ ট্রেড ইউনিয়নের আদলে শ্রমিক কল্যাণ সমিতি গঠনের কথা বলা হলেও ৩০% শ্রমিকের সাক্ষর ছাড়াও ৫০% শ্রমিকের ভোটের মাধ্যমে এবং ইপিজেড কর্তৃপক্ষের অনুমোদনে শ্রমিক কল্যাণ সমিতি গঠনের বিষয়টি কঠিন করা হয়েছে। শ্রম বিধিমালা-২০১৪ এ শ্রমিকদের আহার ও বিশ্রামের সময় কমিয়ে দেওয়া, অংশগ্রহণ কমিটি গঠন এবং পরবর্তীতে সেফটি কমিটি নির্বাচনে মহাপরিদর্শক এর ভূমিকাসহ বিভিন্ন বিষয়ে এখনও অস্পষ্টতা এবং কল্যাণ তহবিলে শ্রমিকদের সাথে ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তাদের সংযুক্ত করা প্রভৃতি বিদ্যমান। অপরদিকে, বিধিমালা পাশের ৬ মাস অতিবাহিত হলেও এখন পর্যন্ত সীমিতসংখ্যক কারখানায় সেফটি কমিটি গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। একইভাবে রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা পরিচালনায় দীর্ঘসূত্রতা এবং বিভিন্ন তদারকি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণে অনীহা দেখা যায়। এছাড়া শ্রমিক অধিকার রক্ষায় শ্রম পরিদপ্তরে ‘হটলাইন’ স্থাপনের উদ্যোগ বাস্তবায়িত হয়নি। শ্রম পরিদপ্তরের কোনো কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মালিকদের সাথে যোগসাজশে ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধনের পূর্বে শ্রমিকদের পরিচয় জানিয়ে দেওয়া এবং ইউনিয়ন নিবন্ধনে বিশেষ স্বার্থ গোষ্ঠীর প্রভাব ও অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের অভিযোগ পরিলক্ষিত হয়। রাজউকের জনবল নিয়োগ এখনো সম্পন্ন হয়নি এবং নকশা যাচাই-বাছাইয়ের জন্য বিশেষজ্ঞ নিয়োগ হয়নি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
গবেষণায় সুশাসনের যেসকল চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করা হয়েছে, তার মধ্যে অনেক ক্ষেত্রে কারখানা পর্যায়ে শ্রমিকদের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা বৃদ্ধি, হেলপার পদে আইনানুগ সুবিধা ছাড়া শ্রমিক ছাঁটাই ও ট্রেড ইউনিয়নের সাথে জড়িত শ্রমিকদের হয়রানি, মামলা বা চাকরিচ্যুত করার বিষয়ে জবাবদিহিতার ঘাটতি, কোনো কোনো কারখানায় অতিরিক্ত এক ঘন্টা কোনো প্রকার মজুরি ছাড়া কাজ করানোর অভিযোগ, নিরাপত্তা নিশ্চিতে ব্যর্থতার কারণে অনেক কারখানা মালিকের নারী শ্রমিকদের জন্য রাত্রিকালীন কাজ না করানোর সিদ্ধান্ত উল্লেখযোগ্য। এছাড়া বিজিএমইএ’র প্রভাবে অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ বিধিমালা-২০১৪ স্থবির কার্যকর না করা, প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে কারখানা পর্যায়ে অতিরিক্ত ৪ কর্মঘন্টা বৃদ্ধির প্রজ্ঞাপনের পাশাপাশি বিজিএমই’র ‘পকেট ট্রেড ইউনিয়ন’ বা ‘ইয়েলো’ ট্রেড ইউনিয়নের কার্যক্রম বৃদ্ধি পাচ্ছে। কোনো কোনো বায়ার কর্তৃক কারখানায় দ্রুত (২-৩ ঘন্টা) জরিপ সম্পন্ন এবং বন্ধের আদেশ প্রদান, এবং জরিপ কার্যে জড়িত রিভিউ প্যানেল ও বিদেশি জরিপ সংস্থার মাঝে মতানৈক্য ও কঠোর কর্তৃত্বপরায়ণ আচরণের অভিযোগ রয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত (কমপক্ষে প্রথম দু-বছর) কারখানায় অর্ডার প্রদান অব্যাহত রাখার বিধান থাকলেও কোনো কোনো ব্র্যান্ড ও বায়ার কর্তৃক অর্ডার কমিয়ে ফেলা বা অর্ডার না দেওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। ‘অ্যালায়েন্স’ স্টিয়ারিং কমিটিতে ট্রেড ইউনিয়ন সম্পৃক্ত না রাখা এবং ‘অ্যাকর্ড’ উপদেষ্টা কমিটিতে মালিক পক্ষের অংশগ্রহণে অনাগ্রহ এ খাতে কারখানার নিরাপত্তা ও শ্রমিক অধিকার নিশ্চিতে গৃহিত উদ্যোগে সফলতা আনয়নে প্রয়োজনীয় শ্রমিক মালিক সম্পর্ক বৃদ্ধির সুযোগ নষ্ট হচ্ছে বলে অভিমত ব্যক্ত করা হয়। একইসাথে কারখানার সংস্কার ও স্থানান্তরে রেমেডিয়েশন ফাইন্যান্সের মাধ্যমে মালিকদের উচ্চ সুদে টাকা ছাড় করা হলে প্রকল্পের উদ্দেশ্য ব্যাহত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে আশংকা প্রকাশ করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে ড. ইফতেখারুজ্জামান তাঁর বক্তব্যে গত তিন বছরে অর্জিত অগ্রগতি ধরে রাখা, বিদ্যমান চ্যালেঞ্জসমূহের বাস্তবায়নে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে সকল অংশীজনের মধ্যে কার্যকর সমন্বয় সাধনের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
তৈরি পোশাক খাতে গৃহিত উদ্যোগ সমূহকে সফলভাবে বাস্তবায়ন ও সুশাসন নিশ্চিতকরণে টিআইবি’র উল্লেখযোগ্য সুপারিশসমূহ হল তৈরি পোশাক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় কেন্দ্রীভূত তদারকি ও সমন্বয়ের জন্য দীর্ঘ মেয়াদে পৃথক মন্ত্রণালয় গঠন, যে সকল কারখানা বিজিএমইএ বা বিকেএমইএ’র সদস্য নয় তাদের টেকনিক্যাল কমপ্লায়েন্স নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ, শ্রমিক কল্যাণ তহবিল গঠন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা, এবং তা দ্রুত বাস্তবায়ন, রানা প্লাজা ও তাজরিন দুর্ঘটনায় দায়েরকৃত বিভিন্ন মামলা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করা, যত দ্রুত সম্ভব শ্রমিক ডাটাবেজ গঠন, পোশাক শিল্পের সাথে জড়িত সব ধরনের কারখানার সমন্বিত তালিকা তৈরি করা, এবং দ্রুত সাব-কন্ট্রাক্টিং গাইডলাইন তৈরি, শ্রম পরিদপ্তরের সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং শ্রমিক সংগঠন ও যৌথ দরকষাকষির অধিকার নিশ্চিতে নিয়মিত পরিদর্শনের ব্যবস্থা করা। অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ বিধিমালা, ২০১৪ দ্রুত কার্যকর করা, কারখানা সংস্কার বাস্তবায়নে বিভিন্ন দাতা সংস্থা কর্তৃক প্রতিশ্রুত ঋণ সহজ সুদে কারখানা মালিকদের দেওয়ার ব্যবস্থা করা। এ ক্ষেত্রে এ তহবিলকে বিশেষ তহবিল হিসেবে বিবেচনা করা। সেইসাথে সকল কারখানায় কল-কারখানা অধিদপ্তরের হটলাইনের নম্বরটি দৃশ্যমান স্থানে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা, এবং এ সম্পর্কে প্রয়োজনীয় প্রচারণার ব্যবস্থা করার পরামর্শ দিয়েছে টিআইবি।