জলবায়ু অভিযোজন তহবিল ব্যবহারে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিতের আহবান বিশেষজ্ঞদের
ঢাকা, ২৯ মার্চ ২০১৬: দেশি ও বিদেশি বিশেষজ্ঞগণ জলবায়ু পরিবর্তনে ঝুঁকির মুখে থাকা দেশগুলোর সরকারের প্রতি জলবায়ু অভিযোজন তহবিলের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় সর্বোচ্চ পর্যায়ের শুদ্ধাচার, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার আহবান জানিয়েছেন । ‘প্যারিস চুক্তির প্রেক্ষিতে, বাংলাদেশ ও অন্যান্য জলবায়ু ঝুঁকির মুখে থাকা দেশগুলোর অবশ্যই সম্মিলিতভাবে কাজ করার উচিত। একক ও সম্মিলিতভাবে সর্বোচ্চ পর্যায়ের শুদ্ধাচার, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে সুশাসনের বহুমুখী ঘাটতি মোকাবেলা করা সম্ভব হবে, অন্যথায় ঝুঁকির মুখে থাকা দেশগুলোর অভিযোজন প্রচেষ্টা ভীষণভাবে ব্যাহত হবে।’ জলবায়ু তহবিল নিয়ে আজ দিনব্যাপি এক আলোচনায় তাঁরা এসব কথা বলেন।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) কর্তৃক আয়োজিত ঢাকার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে (বিআইসিসি) অনুষ্ঠিত ‘জলবায়ু পরিবর্তনে অভিযোজন তহবিল: স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও জনঅংশগ্রহণ বিষয়ে ইন্টিগ্রিটি ডায়ালগ’ শীর্ষক এ অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, নেদারল্যান্ডস, মালদ্বীপ, ইন্দোনেশিয়া, কেনিয়া, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া ও ভারত থেকে অংশগ্রহণকারী প্রতিনিধিবৃন্দ ও জাতীয় বিশেষজ্ঞরা জলবায়ু অর্থায়নের বহুমুখী বিষয়গুলো এবং সুনির্দিষ্টভাবে জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন অর্থায়ন বিষয়ে আলোচনা করেন।
‘অভিযোজন’ শব্দটির সংজ্ঞায়নের ক্ষেত্রে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জের উল্লেখ করে বক্তারা একটি ব্যাপারে একমত যে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অভিযোজনের ঝুঁকিগুলো ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর উন্নয়ন প্রচেষ্টায় বাড়তি চাপ ফেলছে। এছাড়া উন্নত দেশগুলোর সুষ্ঠু ও সময়াবদ্ধ প্রতিশ্রুতি না থাকা, অনুদানভিত্তিক জনতহবিলের অপ্রতুলতা, অভিযোজন প্রকল্পগুলোতে স্থানীয় ঝুঁকির বিবেচনা না করা কিংবা সঠিক প্রয়োগ না করা এবং প্রকল্পের প্রাসঙ্গিক তথ্য প্রকাশ না করা বিষয়ে বক্তারা উদ্বেগ প্রকাশ করেন। এছাড়া জলবায়ু অভিযোজন প্রকল্পের বাস্তবায়ন ও পর্যবেক্ষণে স্থানীয় মানুষের পর্যাপ্ত অংশগ্রহণ না থাকা, অসন্তোষ প্রতিবিধানের যথোপযুক্ত ব্যবস্থা না থাকা এবং অর্থায়ন ও হিসাবরক্ষণে জটিলতা ইত্যাদি বিষয়ে আরও গুরুত্ব সহকারে চিন্তার প্রয়োজন বলে বক্তারা অভিমত প্রকাশ করেন।
বক্তারা সকলেই একমত হন যে, জলবায়ু পরিবর্তন তহবিলগুলো সুশাসনের দুর্বলতা থেকে মুক্ত নয়। ইতোমধ্যেই জলবায়ু প্রকল্পগুলোর পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন পর্যায়ে অনিয়মের নানা ঘটনার কথা জনসম্মুখে আসায় এখনই বিশ্বজুড়ে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের উপযুক্ত সময় বলে তাঁরা অভিমত প্রকাশ করেন। উন্নত বিশ্বের পক্ষ থেকেও স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন বলে মনে করেন তাঁরা। তাঁরা উন্নত বিশ্বের দেশগুলোকে তাদের ‘পলিউটারস পে’ নীতির সম্পূর্ণ বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি রক্ষার আহবান জানান যেন উন্নয়নশীল দেশগুলো জলবায়ু অর্থায়নের টাকা ঋণ হিসেবে নয়, বরং অনুদান হিসেবে পায়। সকল অংশীজনের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণে বক্তারা তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহারের পরামর্শ প্রদান করেন।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি বাংলাদেশ সরকারের কম্পট্রোলার এ্যান্ড অডিটর জেনারেল মাসুদ আহমেদ নিরীক্ষার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত হওয়ার ক্ষেত্রে আরও সময় লাগবে উল্লেখ করে জানান, তাঁর অফিস এ পর্যন্ত শতাধিক জলবায়ু প্রকল্পের নিরীক্ষা সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন করেছে। অনুষ্ঠানের সমাপনী অংশে সম্মানিত অতিথি হিসেবে আরও বক্তব্য রাখেন গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ডের টেকনিক্যাল পরামর্শক ও সেন্টার ফর গ্লোবাল চেঞ্জ (সিএফজি) এর নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান উদ্দিন আহমেদ।
সকালে অনুষ্ঠানের সূচনাপর্বে শুভেচ্ছা বক্তব্যে টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘অদূর ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তনের গুরুতর প্রভাবের ফলে বাংলাদেশের প্রায় দুই কোটি সত্তর লক্ষ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়তে পারে। তিনি বলেন, জলবায়ু অর্থায়ন তহবিলকে সুশাসনের দুর্বলতা থেকে সুরক্ষিত রাখার প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা গ্রহণ নিশ্চিত করতে টিআইবি সদা সচেষ্ট।’
অনুষ্ঠানের প্রথমভাগে, ‘অভিযোজন অর্থায়নে সম্ভাবনা ও প্রতিবন্ধকতা- প্যারিস চুক্তির পর তহবিলের অব্যাহত প্রবাহ’ শীর্ষক অংশে বক্তব্য রাখেন ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের পরিচালক ড. সালিমুল হক, কপ-২১ এ বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের সদস্য ও কমিউনিটি ক্লাইমেট প্রজেক্ট, পিকেএসএফের সমন্বয়ক ড. ফজলে রাব্বি সাদেক এবং অ্যাডাপ্টেশন ফান্ড এনজিও নেটওয়ার্কের প্রধান বিশ্লেষক আলফা কানোগা। এই পর্বটি সঞ্চালনা করেন টিআইবি’র উপ-নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের।
এরপর ‘অভিযোজন অর্থায়নে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও জনঅংশগ্রহণ: উন্নত দেশগুলোর দৃষ্টিভঙ্গী’ শীর্ষক পর্বের সঞ্চালনা করেন অক্সফাম আমেরিকার সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার আনাকা পিটারসন কারভালহো। এ পর্বে বক্তৃতা করেন ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত, সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড এনভাইরনমেন্টাল রিসার্চ, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি; ড. টিমোথি মার্ক ক্যাডম্যান, রিসার্চ ফেলো, ইন্সটিটিউট ফর এথিকস, গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ল, গ্রিফিথ ইউনিভার্সিটি এবং সঞ্জয় বশিষ্ঠ, পরিচালক, ক্লাইমেট অ্যাকশন নেটওয়ার্ক ইন সাউথ এশিয়া (ক্যানসা) এবং টিআইবির ক্লাইমেট ফাইন্যান্স গভর্ন্যান্স বিভাগের সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার এম. জাকির হোসেন খান।
তৃতীয় অধিবেশনে বাংলাদেশ সেন্টার ফর এ্যাডভান্স স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক ড. এ. আতিক রহমানের সঞ্চালনায় ‘জলবায়ু অভিযোজন তহবিলে উন্নয়শীল দেশগুলোর দৃষ্টিভঙ্গী’ শীর্ষক আলোচনা পর্ব চলে। এতে বক্তব্য রাখেন নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স এ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজান আর. খান, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. এ. কে. এনামুল হক, জিআইজেড অফিস বাংলাদেশের ক্লাইমেট ফাইন্যান্স গভর্নেন্স প্রজেক্টের প্রিন্সিপাল অ্যাডভাইজর ড. বিয়োর্ন সারবোর্গ এবং অ্যাডাপ্টিফাই, নেদারল্যান্ডস এর ইয়ান টেলাম।
উল্লেখ্য, বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলার জন্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সহযোগিতা কাঠামোর আওতায় গৃহীত সাতটি প্রধান তহবিলের মধ্যে একটি হল অভিযোজন তহবিল। বাংলাদেশে সব ধরণের জলবায়ু তহবিলের শুদ্ধাচার, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও জনঅংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ২০১১ সাল থেকে জলবায়ু অর্থায়ন সুশাসনে গবেষণা ও অ্যাডভোকেসিতে টিআইবি অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে।