TIB recommends 12 measures to ensure good governance in land acquisition and checking environmental pollution in Rampal and Matarbari projects (Bangla)

রামপাল ও মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ প্রকল্পে ভূমি অধিগ্রহণ ও পরিবেশে দূষণ রোধে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ১২ দফা সুপারিশ টিআইবি’র
ঢাকা, ১৬ এপ্রিল ২০১৫: রামপাল ও মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ প্রকল্প দু’টিতে পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা সম্পাদনে বিভিন্ন অনিয়ম এবং জমি অধিগ্রহণের বিভিন্ন পর্যায়ে দুর্নীতিসহ বিরাজমান সুশাসনের ঘাটতিজনিত বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে ১২ দফা সুপারিশ তুলে ধরেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। আজ সকালে সংস্থার ধানমন্ডিস্থ কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ‘রামপাল ও মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ প্রকল্প: ভূমি অধিগ্রহণ ও পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষায় সুশাসনের চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে টিআইবি। গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন মোহাম্মদ হোসেন, ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার-রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি বিভাগ। টিআইবি’র ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট সুলতানা কামালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপ-নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের এবং রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান।
পরিবেশ সংরক্ষণ বিধি ১৯৯৭ অনুযায়ী লাল তালিকাভুক্ত প্রকল্পের জন্য এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট এসেসমেন্ট (ইআইএ) গাইডলাইন ফর ইন্ডাস্ট্রিজ ১৯৯৭ অনুসরণপূর্বক নির্মোহভাবে প্রকল্পভিত্তিক পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা প্রণয়নের নিয়ম রয়েছে। কিন্তু রামপাল এবং মাতারবাড়ি প্রকল্পের পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা সম্পাদনে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয় নি। সরকার কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন রামপাল প্রকল্পের ইআইএ করেছে একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং জাপানি অর্থায়নে বাস্তবায়নাধীন মাতারবাড়ি প্রকল্পে ইআইএ করেছে একটি জাপানি প্রতিষ্ঠান, যার ফলে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানে স্বার্থের সংঘাতের ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে। রামপালের ইআইএ সম্পাদনে বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভলপমেন্ট বোর্ড (বিপিডিবি) এবং ন্যাশনাল থারমাল পাওয়ারপ্ল্যান্ট কোম্পানী লিমিটেড (এনটিপিসি) এর পক্ষ থেকে বিভিন্ন ধরনের কারিগরি নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে, যা নিরপেক্ষতার মানদন্ডে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। শিল্পসমৃদ্ধ এলাকা বা ফাঁকা জায়গা না হলেও এসব জায়গায় প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিবেশগত ছাড়পত্র দিয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর, যা নিয়মবহির্ভূত। এমনকি রামপাল প্রকল্পের ক্ষেত্রে বন বিভাগের মতামত গ্রহণ না করারও অভিযোগ রয়েছে। রামপাল প্রকল্পে ইআইএ সম্পাদনের আগেই শর্ত ভঙ্গ করে মাটি ভরাটসহ অন্যান্য উন্নয়ন কার্যক্রম শুরু হলেও পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ হতে কোনো আইনানুগ ব্যবস্থা গৃহীত হয়নি।
রামপাল প্রকল্পে গণশুনানিতে অংশগ্রহণকারীদের মতামতকে অগ্রাহ্য করেই ইআইএ চূড়ান্তকরণ এবং মাতারবাড়ি প্রকল্পে স্টেকহোল্ডার সভাগুলো প্রকল্প এলাকার বাইরে হওয়ায় সংশ্লিষ্ট জনগণের মতামত উঠে আসেনি। এমনকি এইসব স্টেকহোল্ডার সভায় অংশগ্রহণকারীদের ‘প্রকল্পের বিরোধিতা না করার’ ব্যাপারে রাজনৈতিক নেতার হুমকি প্রদানের তথ্য পাওয়া গেছে। প্রকল্পের স্থান নির্বাচনে পরিবেশ রক্ষা এবং মানুষের আর্থ-সামাজিক ঝুঁকির চেয়ে প্রকল্পের সুবিধাদিকেই প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (এনভাইরনমেন্টালি ক্রিটিক্যাল এরিয়া - ইসিএ) থেকে ১৫ কিমি নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা থাকলেও রামপাল প্রকল্পে তা মানা হয়নি। এমনকি সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে কয়লা পরিবহন ও কার্বনের ফলে সৃষ্ট দূষণও এখানে বিবেচনায় আনা হয়নি। প্রকল্প দু’টি বাস্তবায়নে সামগ্রিক ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন পরিকল্পনা বিষয়ে তথ্য উন্মুক্ত করা বা স্বপ্রণোদিত তথ্য প্রদান এবং বিনিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের সাথে সম্পাদিত চুক্তির বিষয়গুলোও জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয়নি।
গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রকল্প এলাকায় ভূমি অধিগ্রহণে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাবাসী ক্ষতিপূরণের টাকা উত্তোলনের প্রতিটি স্তরেই অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে ন্যূনতম ক্ষতিপূরণ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ক্ষতিপূরণ প্রদানে প্রকল্পগুলোতে প্রতিটি ফাইল প্রসেসিং-এ নিয়ম-বহির্ভূতভাবে মোট ক্ষতিপূরণের ৩%-১০% পর্যন্ত অগ্রিম ঘুষ আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। ক্ষতিপূরণ প্রদানে প্রশাসনের একাংশ সরাসরি দুর্নীতির সাথে জড়িত এমন তথ্য পাওয়া গেছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের যোগসাজশে চিংড়ি ঘেরের ইজারার ক্ষতিপূরণ অতিমূল্যায়িত করে ইজারাদার নয় এমন ব্যক্তিরাও ক্ষতিপূরণের টাকা উত্তোলন করেছে। ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে বিদ্যমান আইন ও বিধিমালা যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয়নি। অন্যদিকে উভয় প্রকল্পের বিরোধীদের বিরুদ্ধে বিভিন্নভাবে হুমকি প্রদান ও নির্যাতন করা হয়েছে। ন্যায্য ক্ষতিপূরণ না পেয়ে জমি থেকে উচ্ছেদ ও প্রকল্পবিরোধী আন্দোলনের সাথে যুক্ত থাকার কারণে অনেকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অজুহাতে মামলা করা হয়েছে এবং পুলিশের ভয়ে অনেকে পলাতক জীবন যাপন করছে। অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে সময়মতো ক্ষতিপূরণ না পাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্তরা দিনদিন দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রে নিমজ্জিত হচ্ছে বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনে সভাপতির বক্তব্যে অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, “বিদ্যুৎ আমাদের একান্ত প্রয়োজন। কিন্তু জনগণের জীবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে নয়। রামপাল প্রকল্পে শুধু মানুষ নয় প্রাণীকূলও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। জাতীয় স্বার্থে কোন কাজ হলে জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে তা গ্রহণ করে। উভয় প্রকল্পেই ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে দুর্নীতির আশ্রয় নেয়া হয়েছে এবং পরিবেশগত সমীক্ষাগুলোও প্রশ্নবিদ্ধ।”
. ইফতেখারুজ্জামান তাঁর বক্তব্যে বলেন, “উভয় প্রকল্পেই পরিবেশ ও আর্থ-সামাজিক ক্ষতির কথা উল্লেখ করা হয় নি। যারা ক্ষতিপূরণ পাওয়ার কথা তাদের বেশির ভাগই প্রকৃত ক্ষতিপূরণ পান নি। আবার অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি ক্ষতির তুলনায় অধিক ক্ষতিপূরণের টাকা পেয়েছেন। প্রকল্পের কারণে জনগণের জীবন জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কিন্তু প্রকল্পের শর্তাবলী জনগণকে জানানো হয় নি। সারা বিশ্বে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বন্ধ হয়ে গেছে। পরিবেশ দুষণ বিবেচনা করে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প সুনির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে পর্যায়ক্রমে বন্ধ করতে হবে। একই সাথে সৌরবিদ্যুৎ ও বায়ুবিদ্যুতের মতো নবায়নযোগ্য প্রযুক্তির বিকাশ ঘটাতে হবে।”
রামপাল ও মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ প্রকল্পে ভূমি অধিগ্রহণ এবং পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষায় সুশাসন প্রতিষ্ঠায় টিআইবি উত্থাপিত ১২ দফা সুপারিশের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- রামপাল ও মাতারবাড়ি তাপ বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য প্রণীত পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এবং স্বার্থের দ্বন্দ্ব থেকে মুক্ত বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠান/ব্যক্তি কর্তৃক মূল্যায়ন সাপেক্ষে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ; ভূমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসন কর্মপরিকল্পনা অনুসারে মূল্য নির্ধারণ, উপদেষ্টা পর্ষদ ও পুনর্বাসন উপদেষ্টা কমিটি গঠনের মাধ্যমে রামপাল ও মাতারবাড়ি প্রকল্পে ক্ষতিগ্রস্ত জমির মালিকদের ক্ষতিপূরণ পুনঃনির্ধারণ; নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান কর্তৃক জরিপ পূর্বক এ দুটি প্রকল্পের সকল ধরনের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের তালিকা প্রণয়ন এবং নির্ধারিত ক্ষতিপূরণের পরিমাণসহ বিস্তারিত জনসম্মুখে প্রচার; ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে ভূমি অধিগ্রহণ শাখা কর্তৃক প্রকল্প এলাকায় ‘ওয়ান স্টপ’ সার্ভিসের মাধ্যমে স্বল্প সময়ে ক্ষতিপূরণ প্রদানের ব্যবস্থা; প্রকল্পগুলোতে ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণ পাওয়া ও পুনর্বাসনের বিষয়ে অভিযোগ জানানো এবং অভিযোগ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা এবং প্রকল্পগুলোতে ভূমি অধিগ্রহণ ও ক্ষতিপূরণ প্রদানে দুর্নীতির ঘটনা তদন্তের মাধ্যমে প্রমাণ সাপেক্ষে দোষীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ।
ভবিষ্যতে বাস্তবায়নাধীন শিল্প প্রতিষ্ঠান ও ভূমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত সুপারিশের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো -পরিকল্পনাধীন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা ১৯৯৭ অনুযায়ী উপযুক্ত এলাকায় স্থাপনে স্বার্থের দ্বন্দ্ব থেকে মুক্ত ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত প্রতিষ্ঠান/বিশেষজ্ঞের দ্বারা পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা সম্পন্ন করা, পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা প্রক্রিয়ায় জনঅংশগ্রহণ; স্থাবর সম্পত্তি হুকুম দখল আইন ১৯৮২ সংস্কার করে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে ন্যূনতম পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে ক্ষতিপূরণ প্রদান এবং পুনর্বাসন; ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ এবং পুনর্বাসন পরিকল্পনায় জনঅংশগ্রহণ/মতামত গ্রহণের বিধান অন্তর্ভুক্তকরণ; জমির স্বত্বাধিকারী এবং স্বত্বাধিকারহীন উভয় ধরনের ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণের আওতায় নিয়ে আসার বিষয়সমূহ অন্তর্ভুক্তকরণ; কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য আলাদা পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা গাইডলাইন প্রণয়ন; কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সম্পাদিত অংশীদারিত্ব এবং ঋণ চুক্তি জনসম্মুখে প্রচার; প্রকল্প থেকে পাওয়া লভ্যাংশের একটা অংশ আইন প্রণয়নের মাধ্যমে প্রকল্প এলাকার উন্নয়নের জন্য ব্যয় এবং প্রকল্পের লভ্যাংশ থেকে ভূমি হারানো ব্যক্তিদের জন্য স্থায়ী অর্থ সংস্থানের ব্যবস্থা গ্রহণ ইত্যাদি। সর্বোপরি পরিবেশের দূষণ বিবেচনা করে কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প সুনির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে পর্যায়ক্রমে বন্ধ করতে হবে। বিকল্প হিসেবে সৌরবিদ্যুৎ এবং বায়ুবিদ্যুতের মত নবায়নযোগ্য প্রযুক্তির বিকাশ ঘটাতে হবে। 

Media Contact


Press Release