সংসদ বর্জনের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতায় টিআইবি’র উদ্বেগ;
আইন করে দলীয় বা জোটগতভাবে সংসদ বর্জন বন্ধ করার আহ্বান
ঢাকা, ০২ জুন, ২০১৩: বিরোধীদল কর্তৃক জাতীয় সংসদ বর্জনের ধারা অব্যাহতভাবে বৃদ্ধিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে টিআইবি সংসদের কার্যকরতা বৃদ্ধিতে গবেষণালব্ধ তথ্যের আলোকে ১৮ দফা সুপারিশ বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছে। নবম জাতীয় সংসদের অষ্টম হতে পঞ্চদশ পর্যন্ত মোট ৮টি অধিবেশনের তথ্য বিশ্লেষণ করে প্রণীত ‘পার্লামেন্ট ওয়াচ’ রিপোর্ট প্রকাশ উপলক্ষ্যে আয়োজিত সাংবাদিক সম্মেলনে টিআইবি’র পক্ষ থেকে এই দাবি জানানো হয়।
‘পার্লামেন্ট ওয়াচ - নবম জাতীয় সংসদের অষ্টম-পঞ্চদশ অধিবেশন’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “সংসদীয় গণতন্ত্রে সংসদে সরকার ও বিরোধী দলের উপস্থিতি ও সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং সুস্থ ও ইতিবাচক বিতর্ক বিশ্বজনীন বৈশিষ্ট্য হলেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে নবম জাতীয় সংসদে প্রধান বিরোধী দলের সংসদ বর্জনের উর্ধ্বমুখী প্রবণতা বাংলাদেশে গণতন্ত্র শক্তিশালীকরণে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংসদ বর্জনের এই সংস্কৃতি সংসদীয় গণতান্ত্রিক চর্চায় বৈশ্বিক অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে অদ্বিতীয়, যা একদিকে যেমন বিব্রতকর, অন্যদিকে তেমনি জনগণের ভোট ও রায়ের প্রতি শ্রদ্ধাহীনতার পরিচায়ক।” বর্তমান নবম সংসদের ৮টি অধিবেশনের ১৬৩ কার্যদিবসের মধ্যে প্রধান বিরোধী দল মাত্র ১০টি কার্যদিবসে উপস্থিত ছিল উল্লেখ করে তিনি প্রধান বিরোধী দলকে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকরণে নির্বাচনী অঙ্গীকার ও জন প্রত্যাশার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার আহ্বান জানান।
উল্লেখ্য, জাতীয় সংসদের কার্যক্রম নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে টিআইবি অষ্টম জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন থেকে নিয়মিতভাবে ‘পার্লামেন্ট ওয়াচ’ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে আসছে। বর্তমান প্রতিবেদনের সময়কাল ২০১১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত অনুষ্ঠিত নবম সংসদের অষ্টম থেকে ১৫তম অধিবেশন। যে সকল সূচকের মাধ্যমে আলোচ্য গবেষণায় তথ্য বিশ্লেষিত হয় তার মধ্যে সংসদে ব্যয়িত সময়, সংসদ সদস্যদের উপস্থিতি, সংসদ বর্জন, ওয়াক আউট, কোরাম সংকট, আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত কার্যক্রম, সংসদের বিভিন্ন কার্যক্রমে নারী সদস্যদের অংশগ্রহণ, স্পীকারের ভূমিকা, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কার্যক্রম অন্যতম।
নবম সংসদের ৮ম থেকে ১৫তম অধিবেশনের মোট ১৬৩টি কার্যদিবসের মধ্যে ২৩% ব্যয়িত হয় বাজেট আলোচনায়, ১৯% সময় ব্যয়িত হয় রাষ্ট্রপতির ভাষণের উপর আলোচনায়, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীদের প্রশ্নোত্তর পর্বে ২২%, জনগুরুত্বপূর্ণ নোটিসের ওপর আলোচনায় ১১%, এবং আইন প্রনয়ণে ৭%। উল্লেখ্য আইন প্রনয়ণে ভারতীয় লোকসভায় ৩০% এবং যুক্তরাজ্যের হাউস অব কমন্সে ৫৫% সময় ব্যয় হয়। আলোচ্য সময়ে সংসদে একটি বিল পাশ করতে ১৩ মিনিট ব্যয়িত হয়। ভারতের লোকসভায় ৬০% বিল পাশের ক্ষেত্রে প্রতিটি বিলে ১-২ ঘন্টা সময় ব্যয়িত হয়।
আলোচ্য সময়ে অধিবেশনগুলোকে সদস্যদের গড় উপস্থিতি ছিল ৬৬%। সরকারি জোটের ১৩.৭৩% সদস্য ৫০% বা তার কম সংখ্যক অধিবেশনে অংশগ্রহণ করেন। ৩৮.৫৬% সদস্য ৫১-৭৫% অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন। ৭৫% এর অধিক অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন এমন সদস্যের হার ৫০% এরও কম (৪৭.৭১%)। প্রধানমন্ত্রী প্রায় ৮৬% শতাংশ কার্যদিবস এবং প্রধান বিরোধী দলীয় নেতা ১.৮৪% কার্যদিবস সংসদে উপস্থিত ছিলেন। উল্লেখ্য, ১৬৩ কার্যদিবসের মধ্যে ১৫৩ কার্যদিবস সংসদ বর্জন করেও বিরোধী দলীয় সংসদ সদস্যরা প্রাপ্য আর্থিক সুবিধাদি গ্রহণ করেছেন। প্রাপ্য আর্থিক সুবিধাদির ভিত্তিতে একজন সংসদ সদস্যের একদিনের অনুপস্থিতির প্রাক্কলিত অর্থমূল্য ৩,৫৫৮ টাকা। এ হিসেবে প্রথম থেকে ১৫শ অধিবেশন পর্যন্ত বিরোধী জোটের সকল সদস্যের সংসদ বর্জনের অর্থমূল্য ৪ কোটি ১ লক্ষ ৩৪ হাজার টাকা। তবে প্রধান বিরোধী দলের সদস্যরা কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন ও কমিটির বৈঠকে নিয়মিত অংশগ্রহণ করেছেন।
গবেষণাভুক্ত সময়ে সংসদ অধিবেশনগুলোতে বছরে গড় কার্যদিবসগুলোতে ব্যয়িত দৈনিক গড় সময় ছিল মাত্র ৩ ঘন্টা, যুক্তরাজ্যের ক্ষেত্রে যা ৮ ঘন্টা এবং ভারতের ক্ষেত্রে প্রায় ৬ ঘন্টা। অন্যদিকে আটটি অধিবেশনে কোরাম সংকটের কারণে অধিবেশনসমূহ মোট ৭২ ঘন্টা ২২ মিনিট বিলম্বিত হয়। প্রতি কার্যদিবসের গড় কোরাম সংকটজনিত বিলম্ব ছিল প্রায় ২৪ মিনিট। সংসদ অধিবেশন পরিচালনা করতে প্রতি মিনিটে গড় ব্যয় প্রায় ৭৮ হাজার টাকা। এ হিসাবে প্রতি কার্যদিবসের গড় কোরাম সংকটের সময়ের অর্থমূল্য প্রায় ১৯ লক্ষ সাত হাজার একশত টাকা।
উল্লিখিত সময়ে সংসদীয় প্রক্রিয়ায় নারী সদস্যদের ইতিবাচক অংশগ্রহণের প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নোত্তর পর্বে নারী সদস্যরা ২২ মিনিটেরও বেশী সময় নিয়েছেন। এছাড়া ৩৭ জন নারী সদস্য জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মনোযোগ আকর্ষণ নোটিশ প্রদান করেছেন এবং ৭১ বিধিতে নারী সদস্যরা ৪০টি নোটিশ দিয়েছিলেন। তবে আইন প্রণয়নে নারী সদস্যদের অংশগ্রহণ ছিল সীমিত ।
উল্লেখ্য আলোচ্য ৮টি অধিবেশনের সভাপতি হিসেবে স্পীকার ১৯৬ ঘন্টা, ডেপুটি স্পীকার ১৪৫ ঘন্টা এবং সভাপতি প্যানেলের সদস্যরা প্রায় ৬১ ঘন্টা দায়িত্ব পালন করেন। আলোচ্য সময়ে স্পিকার ৪টি রুলিং প্রদান করেন। এছাড়া স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে কার্যপরিচালনার সময়ানুবর্তিতা রক্ষায় ইতিবাচক অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়।
আলোচ্য সময়ে ৫১ টি সংসদীয় কমিটি ১৬৬১টি বৈঠক এবং ১৫৮টি উপকমিটি ৫৭৩ টি বৈঠক করে। গবেষণাভূক্ত সময়ে ৩৭টি কমিটি প্রতিবেদন জমা দিলেও ১৪টি কমিটি এখনও পর্যন্ত কোন প্রতিবেদন জমা দেয়নি। কমিটিগুলো প্রায় ২৫০০ সুপারিশ প্রদান করে। এর মধ্যে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ১২টি কমিটি কর্তৃক প্রদত্ত ১৪৫৩টি সুপারিশের ৬৩১টি (৪৩%) বাস্তবায়িত হয়েছে মাত্র।
সংসদে আলোচনার ক্ষেত্রে অসংসদীয় ও অশালীন ভাষা ব্যবহারের চর্চা এখনো বিদ্যমান রয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে সংসদ সদস্য আচরণ বিল ২০১০ কে আইন হিসেবে অনুমোদনের দাবি জানানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনে সংসদকে অধিকতর কার্যকর করতে টিআইবি’র পক্ষ থেকে ১৮ দফা সুপারিশ উত্থাপন করে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “আমরা সংসদকে কার্যকর দেখতে চাই, সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতি প্রতিরোধে যা অপরিহার্য। কার্যকর সংসদ প্রতিষ্ঠার লক্ষে প্রয়োজনে আইন করে দলীয় বা জোটগতভাবে বর্জনের সংস্কৃতি বন্ধ করতে হবে।”
টিআইবি’র উত্থাপিত সুপারিশগুলোর মধ্যে অন্যতম হল: আইন করে দলীয় বা জোটগতভাবে সংসদ বর্জন নিষিদ্ধ করা, অনুপস্থিতির সময়সীমা ৯০ কার্যদিবেসের পরিবর্তে উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে এনে উদাহরণস্বরূপ ৩০ কার্যদিবস করা এবং অনুমোদিত ছুটি ব্যতিত একটানা সাত কার্যদিবসের বেশী অনুপস্থিত থাকা নিষিদ্ধ করা, স্বাধীন ও আত্মসমালোচনামূলক মতামত প্রকাশ ও ভোটদানের স্বার্থে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের সংশোধন, বছরে ১৩০ দিন সংসদ কার্যদিবস এবং প্রতি কার্যদিবসের সময় ৬ ঘন্টা করা, বিধি, প্রবিধান, নীতিমালার খসড়া সম্পর্কে জনমত গ্রহণে এ সংক্রান্ত তথ্যাদি ওয়েবসাইট ও গণমাধ্যমে প্রকাশ করা, জাতীয় জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে গণভোটের ব্যবস্থা প্রবর্তন করা, আর্ন্তজাতিক চুক্তি বিষয়ে সংসদে আলোচনার বিধান ফিরিয়ে আনা এবং সংসদীয় কমিটি স্বার্থের দ্বন্দ্বের অভিযোগের সুব্যবস্থা করা।