স্থানীয় পর্যায়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় কার্যকর নারী জনপ্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে- টিআইবি
ঢাকা, মার্চ ৭, ২০১২: ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে আজ ঢাকায় ‘স্থানীয় পর্যায়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় নারী জনপ্রতিনিধি: সম্ভাবনা, বাস্তবতা ও করণীয়’ শীর্ষক এক গোলটেবিল আলোচনায় ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভায় সংরক্ষিত নারী আসনের সদস্যদের কার্যকর অংশগ্রহণ ও ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
টিআইবি’র ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট সুলতানা কামালের সভাপতিত্বে আয়োজিত এই গোলটেবিল আলোচনায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় সংসদের হুইপ সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি, এমপি। অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, নিলোফার চৌধুরী মনি এমপি, এসডিএলজি-এআরডি এর ডেপুটি চিফ অব পার্টি ড. জারিনা রহমান খান, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির শিক্ষক ড. দিলারা চৌধুরী, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব লোকাল গর্ভনমেন্ট এর পরিচালক আকরামুল হক সহ বিভিন্ন সমমনা সংগঠনের প্রতিনিধি, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি, নারী উন্নয়ন কর্মী, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি এবং গণমাধ্যমকর্মী।
অনুষ্ঠানে কার্যপত্র উপস্থাপন করেন মো. শরিফুল ইসলাম, সিনিয়র ম্যানেজার, জেন্ডার, টিআইবি।
আলোচনায় অংশ নিয়ে জাতীয় সংসদের সদস্য নিলোফার চৌধুরী মনি জনপ্রতিনিধিদের বক্তব্যের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে বলেন, “সংরক্ষিত কথাটি বলার মাধ্যমেই নারীর অবস্থানকে হেয় করে রাখা হয়েছে, যা কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় উভয় ক্ষেত্রেই সমভাবে প্রযোজ্য। অন্যদিকে ২০১২ সালের পৌরসভা নির্বাচনে কোন বড় রাজনৈতিক দলই কোন নারী প্রতিনিধিকে নির্বাচনে মনোনয়ন দেয়নি যা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়”
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব লোকাল গর্ভনমেন্ট এর পরিচালক আকরামুল হক বলেন ”আইনের সীমাবদ্ধতা নয় বরং প্রয়োগের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকার অর্থই হচ্ছে দুর্বল শাসন ব্যবস্থা। যার ফলে দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি হয়।”
ইউএসএআইডি এর এসডিএলজি-এআরডি প্রকল্পের ডেপুটি চিফ অব পার্টি ড. জারিনা রহমান খান বলেন, “ক্ষমতায়ন একটি প্রক্রিয়া যা একদিনে অর্জন সম্ভব নয়। পর্যায়ক্রমিক পরিবর্তনের মাধ্যমে ক্ষমতায়নের গতিকে ত্বরান্বিত করা সম্ভব। আমাদেরকে যেকোন সমস্যা সমাধানের জন্য ইতিবাচক অর্জন দিয়েই শুরু করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে আইনের যতসামান্য সংশোধন করলেই তা সম্ভব।”
প্রধান অতিথির বক্তব্যে জাতীয় সংসদের হুইপ সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি, এমপি বলেন, যেকোন সমস্যা সমাধানের জন্য টিমওয়ার্ক প্রয়োজন। কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় সরকারের সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে স্থানীয় সরকার সংস্থার প্রতিনিধিদের সমস্যা সমাধান করা সম্ভব।” তিনি আরো বলেন, “নারী প্রতিনিধিদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে যথাযথ সুযোগ না পাওয়া। নারীদেরকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে হবে। নারীর অর্থনৈতিক মুক্তিই পারে নারীর অধিকার নিশ্চিত করতে।”
টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন,“গত এক দশকে স্থানীয় সরকার পর্যায়ে নারী নেতৃত্বের সংখ্যাগত অবস্থান আশাব্যঞ্জক হলেও এই সংখ্যাগত প্রতিনিধিত্বের গুণগত পরিবর্তনের লক্ষ্যে ও নারীর নেতৃত্বের সম্ভাবনাকে পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য সংশ্লিষ্ঠ আইনে নারী প্রতিনিধিদের ভূমিকা সুস্পষ্টকরণ ও মানসিকতার পরিবর্তন অপরিহার্য।” নারী জনপ্রতিনিধিকে যথাযথভাবে তাদের দায়িত্ব পালনের জন্য প্রয়োজনীয় সক্ষমতা বৃদ্ধি, পুরুষতান্ত্রিকতা পরিহার ও অধিক জনসচেতনতার প্রয়োজন রয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
চেয়ারপারসনের বক্তব্যে অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, “স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহ যতদিন শক্তিশালী না হবে ততদিন সুশাসন নিশ্চিত হবে না। সুশাসন নিশ্চিত না হলে দুর্নীতিও প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়।”
অনুষ্ঠানে উপস্থাপিত কার্যপত্র অনুযায়ী, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বাস্তবায়নে ৮৪.৯৩ শতাংশ নারী সদস্যের বৈষম্যের অভিজ্ঞতা রয়েছে যার মধ্যে ৮২.৭০ শতাংশ ইউপি সদস্য এবং ৯০.৪৮ শতাংশ পৌরসভার নারী সদস্য। মাত্র ৪৩.৮৪ শতাংশ নারী সদস্য পুরুষ সদস্যদের কাছ থেকে শ্রদ্ধাপূর্ণ বা সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ পেয়ে থাকেন যদিও ৮৮ শতাংশ নারী সদস্য নিয়মিতভাবে সভায় অংশগ্রহণ করেন, তাদের মধ্যে বেশিরভাগ নারী সদস্যই সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারেন যদি পুরুষ সদস্যদের কাছ থেকে এ ব্যাপারে সমর্থন পান। এছাড়া সময় মত তথ্য প্রাপ্তি, উন্নয়ন প্রকল্পের বরাদ্দ প্রাপ্তি এবং বাজেট প্রণয়নসহ বিভিন্ন বিষয়ে নারী প্রতিনিধিরা বৈষম্যের শিকার হন। স্থানীয় উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণে নারী সদস্যরা বিভিন্নভাবে বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং তাদের মধ্যে যে সম্ভাবনা রয়েছে তা পুরোপুরি ব্যবহারের সুযোগ গ্রহণে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো সফল হতে পারছে না বলে কার্যপত্রে উল্লেখ করা হয়।
নারী জনপ্রতিনিধিদের প্রতি এই বৈষম্য, অবহেলা ও প্রতিবন্ধকতা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় অন্যতম অন্তরায় হিসেবে কাজ করছে উল্লেখ করে টিআইবি উত্থাপিত সুপারিশমালার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল: সংরক্ষিত আসনের নারী সদস্যদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সুস্পষ্টকরণ ও এ সম্পর্কিত বিধিমালা প্রণয়ন; জেন্ডার ম্যানুয়াল (নারীর প্রতি আচরণ সম্পর্কিত) তৈরি এবং সে বিষয়ে পর্যায়ক্রমে সকল সদস্যদের ওরিয়েন্টেশন প্রদান; বিভিন্ন কমিটিতে সক্রিয় ও কার্যকরভাবে কাজ করার জন্য দক্ষতা উন্নয়ন মূলক প্রশিক্ষণ প্রদান; নারী সদস্যদের দাপ্তরিক কাজের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত সুবিধা নিশ্চিতকরণ (যেমন: বসার জন্য নির্ধারিত স্থান, টয়লেট সুবিধা) থাকা; নারী সদস্যদের তথ্যে অবাধ অধিগম্যতা নিশ্চিতকরণ (সরকারি পরিপত্র, আইনগত বিধি-বিধান ও প্রয়োজনীয় সকল নথি); ও স্থানীয় সরকার বিভাগের কার্যক্রম ও সুশাসন তদারকির জন্য মনিটরিং ব্যবস্থার প্রবর্তন।
উল্লেখ্য, অনুষ্ঠানে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নারী প্রতিনিধিদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, হামিদা বেগম, কাউন্সিলর, মধুপুর পৌরসভা; ডালিয়া খাতুন, কাউন্সিলর, বগুড়া পৌরসভা; সুলতানা রাজিয়া, কাউন্সিলর, সাভার পৌরসভা; রিনা পাল, প্যানেল মেয়র, মুক্তাগাছা পৌরসভা; শিলা দাস, সদস্য, ঢোলঘাট ইউনিয়ন পরিষদ, পটিয়া; এবং মমতাজ বেগম, সদস্য, ৪নং কুমারগাতা ইউনিয়ন পরিষদ, মুক্তাগাছা।