৫ জুন টিআইবি কর্তৃক আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে পঠিত সংবাদ বিবৃতি
৩ জুন মহান জাতীয় সংসদে টিআইবি’র ট্রাস্টি বোর্ডের সম্মানিত সদস্য অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ও টিআইবি সম্পর্কে আলোচনার প্রেক্ষিতে টিআইবি’র অবস্থান
সুপ্রিয় সাংবাদিক ভাই ও বোনেরা,
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) - এর পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা। আজ এই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত হওয়ার জন্য আপনাদের ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই।
বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও টিআইবি’র ট্রাস্টি অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সম্পর্কে গত রবিবার অনুষ্ঠিত আলোচনা সঠিক হয় নি মর্মে জাতীয় সংসদে ডেপুটি স্পিকার শওকত আলীর বক্তব্যের জন্য তাঁকে আমরা ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। বিগত ২ জুন টিআইবি আয়োজিত সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) ও ইয়ুথ এনগেজমেন্ট অ্যান্ড সাপোর্ট (ইয়েস) এর জাতীয় সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে ইয়েস সম্মেলনে প্রদত্ত অধ্যাপক সায়ীদের বক্তব্য সঠিকভাবে না জেনে গণমাধ্যমের একাংশের প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে সংসদে এ নিয়ে আলোচনা সম্পর্কে ডেপুটি স্পিকারের বিজ্ঞচিত অবস্থানের ফলে টিআইবি’র দৃষ্টিতে বিষয়টির যথার্থ সমাধানের পথ উন্মোচিত হয়েছে। তাঁকে অভিনন্দন জানাই। এটি এমন একটি দৃষ্টান্ত যে, সকল চ্যালেঞ্জই সম্ভাবনার সৃষ্টি করতে পারে, যদি তা প্রজ্ঞার সাথে মোকাবেলা হয়। ডেপুটি স্পিকারের এই দৃষ্টান্ত বহুমুখী প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সংসদের ওপর জনগণের আস্থা বৃদ্ধির আশা সঞ্চার করেছে। তবে যেহেতু, রবিবার জাতীয় সংসদে আলোচিত বক্তব্য এক্সপাঞ্জ হয় নি এবং যেহেতু সংসদের রবিবারের আলোচনায় টিআইবি প্রসঙ্গে কিছু প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে সেহেতু উক্ত আলোচনা সম্পর্কে আমাদের অবস্থান ব্যাখ্যা করবার জন্যই এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে।
মাননীয় ডেপুটি স্পিকার যথার্থই বলেছেন, কোন বিশেষ পত্রিকা দেখে অধ্যাপক সায়ীদ সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করা সঠিক হয় নি। আমরা গতকালই মাননীয় স্পিকার ও তাঁর মাধ্যমে এবং গণমাধ্যম সূত্রে যে কয়জন সংসদ সদস্য উক্ত বিষয়ে বক্তব্য দিয়েছিলেন তাদের অবগতির জন্য অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের বক্তব্যের একটি সিডি ও তার ট্রান্সক্রিপ্ট প্রেরণ করেছি। সংসদ নেতা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকেও কপি দিয়েছি। ট্রান্সক্রিপ্টেরর কপি আপনাদেরকেও দেওয়া হচ্ছে। তাই এ বিষয়ে আর বিশেষ কিছু জানাবার নেই। তবে অসম্পূর্ণ বা ভিত্তিহীন তথ্যের ওপর নির্ভর করে মহান সংসদসহ যে কোন পর্যায়েই যেমন কাউকে অভিযুক্ত বা দোষী সাব্যস্ত করা ঠিক না তেমনি অন্য সকল ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মতো গণমাধ্যমের কাজেও ভুল বা অপরিপূর্ণতা থাকতে পারে এটাই স্বাভাবিক। আমাদের সকলেই উচিত এ বিষয়ে সজাগ থাকা। এ ঘটনায় টিআইবি’র মতে সবচেয়ে বড় শিক্ষণীয় হচ্ছে আমাদের প্রত্যেকেরই কথা ও কাজের গ্রহণযোগ্যতা, যথার্থতা, বিশেষ করে তথ্য ও মন্তব্যের বস্তুনিষ্ঠতা সম্পর্কে চিরন্তন সজাগ থাকার বিকল্প নেই।
গত রবিবার জাতীয় সংসদের আলোচনায় টিআইবি সম্পর্কে কিছু মন্তব্য করা হয়েছে। এ ব্যাপারে আমাদের অবস্থান নিম্নরূপ:
টিআইবি’র সকল কার্যক্রম সরকারের, বিশেষ করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আওতাধীন এনজিও ব্যুরোর অনুমোদনক্রমে বাস্তবায়ন হয়। শুধুমাত্র সরকারের অনুমতি সাপেক্ষেই যুক্তরাজ্যের ডিএফআইডি, সুইজারল্যান্ডের এসডিসি, সুইডেনের সিডা এবং ডেনমার্কের ড্যানিডা এর অর্থায়নে টিআইবি’র কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। উল্লেখ্য, এই ৪টি দাতা সংস্থা বাংলাদেশ সরকারের দ্বি-পক্ষীয় দাতাও বটে। এছাড়া জার্মান সরকারের পরিবেশ মন্ত্রণালয়, ইউএনডিপি ও এফকে নরওয়ে নামক প্রতিষ্ঠানও টিআইবিকে প্রকল্প সহায়তা দিচ্ছে।
২০০৭-৮ মেয়াদে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কর্মকান্ডের সাথে টিআইবি’র সম্পৃক্ততা সম্পর্কে যে বক্তব্য উপস্থাপিত হয়েছে, সেটিও কল্পনাপ্রসূত এবং বিদ্যমান সত্যের অপলাপ মাত্র। গণমাধ্যমেই সেই সময়ে টিআইবি’র সুনির্দিষ্ট ভূমিকার অজস্র উদাহরণ রয়েছে যেখানে টিআইবি গণতন্ত্র, জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সংসদ এবং যোগ্য ও সৎ প্রার্থীর অনুকূলে দৃঢ়তার সাথে প্রাতিষ্ঠানিক অবস্থান তুলে ধরেছিল। আপনাদের স্মরণ থাকতে পারে, উক্ত সরকারের সময়েই সিডর পরবর্তী ত্রাণ কার্যক্রমে দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ করায় অতীব ক্ষমতাধর একাধিক উপদেষ্টার তীব্র সমালোচনা ও ক্রোধের শিকার হয়েছিল টিআইবি। ট্রুথ কমিশনের মতো অসাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করা, সম্পূর্ণ যুক্তিহীনভাবে শীর্ষ পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দসহ দুর্নীতির অভিযোগে দীর্ঘদিন জামিন না মঞ্জুর করে আটক রাখাকে ক্ষমতার অপব্যবহার হিসেবে দুর্নীতিরই নামান্তর বলে সুস্পষ্ট বক্তব্য উত্থাপন করেছিল টিআইবি।
অন্যদিকে তৎকালীন দুর্নীতি দমন কমিশনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে তাদের দুর্নীতি-বিরোধী প্রচারণা কার্যক্রমে আমরা সহায়তা করেছি সেটিও গর্বের সাথে স্মরণ করতে আমরা দ্বিধা করি না। কারণ আমাদের কাজ কোন সরকারের বা কোন প্রতিষ্ঠানের পক্ষে বা বিপক্ষে নয়। আমাদের অবস্থান দুর্নীতির বিরুদ্ধে। এক্ষেত্রে যারা আমাদের সাথে একাত্ম হয়ে কাজ করতে আগ্রহী আমাদের সামর্থ্য ও নীতি অনুযায়ী আমরা তাদের সাথে সহায়তা করতে সদা প্রস্তুত। তবে, সেসব প্রতিষ্ঠানের কৃতিত্ব, ব্যর্থতা বা অনিয়মের অংশীদার আমরা হতে পারি না।
সংসদ, গণতন্ত্র নিয়ে টিআইবিকে কথা বলার অধিকার কে দিয়েছে মর্মে যে বক্তব্য এসেছে সে সম্পর্কে টিআইবি মনে করে সুশাসনের পক্ষে জনমত তৈরিতে যে ধরণের গবেষণা ও অ্যাডভোকেসি কার্যক্রম টিআইবি পরিচালনা করে থাকে তাতে সংসদের কার্যকারিতা বা গণতান্ত্রিক চর্চার মত জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কোন কথা না বলাই বরং অসঙ্গত হবে। তাছাড়া সংবিধানের ৭ (১) অনুযায়ী জনগণ সকল ক্ষমতার উৎস বিধায় এবং ২১(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জনগণের দায়িত্ব পালনের যে বাধ্যবাধকতা রয়েছে তা জনগণের পক্ষ হয়ে টিআইবি পালন করছে এবং এর অনুমতি সরকারই দিচ্ছেন বিধায় টিআইবি’র কর্মকান্ডের এখতিয়ার অত্যন্ত পরিষ্কার।
এ প্রসঙ্গে টিআইবি দৃঢ়ভাবে জানাতে চায় টিআইবি’র সকল কর্মকান্ড এবং অর্থ ব্যয় সরকার কর্তৃক অনুমোদিত। এ সম্পর্কিত সকল তথ্য টিআইবি’র ওয়েবসাইটসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনের মাধ্যমে নিয়মিত প্রকাশ করা হয়। টিআইবি’র দুর্নীতিবিরোধী সামাজিক আন্দোলন মূলতঃ সরকারের দুর্নীতিবিরোধী কর্মসূচিরই পরিপূরক। গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের স্বার্থে মহান সংসদসহ জাতীয় সততা ব্যবস্থার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ওপর টিআইবি তার গবেষণা ও অ্যাডভোকেসি কার্যক্রম সচল রেখেছে।
আমাদের কার্যক্রমের প্রতি কোন কোন প্রভাবশালী মহলের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সত্ত্বেও আমাদের উদ্যোগে বেশ কিছু আইনী ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার হয়েছে। সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন প্রতিষ্ঠার দাবি ও তার প্রেক্ষিতে কমিশন গঠন এবং পরবর্তীতে কমিশনের ক্ষমতা খর্ব করার উদ্যোগের বিরুদ্ধে অব্যাহত ক্যাম্পেইন; জাতিসংঘের দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক কনভেনশনের সদস্য হিসেবে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি; তথ্য অধিকার আইন, তথ্য প্রকাশকারীর সুরক্ষা আইন ইত্যাদির মতো অনেক ইতিবাচক অগ্রগতি হয়েছে। যাতে রয়েছে টিআইবি’র প্রত্যক্ষ ভূমিকা। এসবের মূল লক্ষ্য দেশে দুর্নীতি প্রতিরোধক প্রাতিষ্ঠানিক সামর্থ্য বৃদ্ধি করা, যার ফলে দুর্নীতি একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে সুনির্দিষ্টভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে এবং অবস্থান বা পরিচয় নির্বিশেষে সকলের জন্য প্রযোজ্য হবে।
টিআইবি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে জনগণ এবং জনপ্রতিনিধিদের যৌথ প্রয়াসেই দেশের গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করবে। সেক্ষেত্রে জনগণের সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতির কোন বিকল্প নেই এবং জনপ্রতিনিধিদের জনগণের সহযোগী হয়েই কাজ করতে হবে।