দুর্নীতির ধারণা সূচক ২০১২’তে বাংলাদেশের স্কোর ও অবস্থান নিম্নমুখী
দুর্নীতি প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য আহ্বান জানিয়েছে টিআইবি
ঢাকা, ডিসেম্বর ০৫, ২০১২: বার্লিন-ভিত্তিক ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল পরিচালিত দুর্নীতির ধারণা সূচক ২০১২ অনুযায়ী বাংলাদেশের স্কোর ও অবস্থান গত বছরের তুলনায় অনেক কমেছে। এ উদ্বেগজনক অবস্থান নিরসনে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে এদেশে অবস্থিত আন্তর্জাতিক সংগঠনটির অন্যতম চ্যাপ্টার ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। বিশ্বের ১৭৬টি দেশে দুর্নীতির ব্যাপকতার বিষয়ে টিআই এ বছর এ জরিপ পরিচালনা করেছে।
দুর্নীতির ধারণা সূচক ২০১২ এর একযোগে বৈশ্বিক প্রকাশ উপলক্ষে আজ ব্র্যাক সেন্টার- এ আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরে টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘‘২০১২ সালে সূচকটির ০-১০ স্কেল রূপান্তর করে ০-১০০ স্কেলে বিবেচনা করা হয়েছে। এবার ১৭৬ টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের স্কোর ২৬, নিম্নক্রম অনুযায়ী অবস্থান ত্রয়োদশ এবং উচ্চক্রম অনুযায়ী ১৪৪তম। এখানে লক্ষণীয় যে, এবারের সূচকে বাংলাদেশের স্কোর কমেছে ১। তালিকার উচ্চক্রম অনুযায়ী গত বছরের অবস্থান ১২০ থেকে কমে ১৪৪ এ এসেছে। অর্থাৎ এ বছরের সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ২৪ ধাপ নিচে নেমেছে, যা উদ্বেগজনক। অন্যদিকে তালিকার নিম্নক্রম অনুযায়ী বাংলাদেশের এবারের অবস্থান ২০১১ সালের সূচকে ১৮৩টি দেশের মধ্যে এবারের মতো একই অর্থাৎ ত্রয়োদশ রয়েছে।”
এ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন টিআইবি ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল। তিনি বলেন, “দুর্নীতি, অনিয়ম, অবিচার থাকলে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশের দরিদ্র জনগণ, যেকোন দায়িত্বশীল নাগরিকের কর্তব্য হচ্ছে দুর্নীতি প্রতিরোধে সরকারকে সহযোগিতা করা। তাই গণমাধ্যম, সুশীল সমাজসহ বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে আরো বেশী দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।” অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, টিআইবি ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য এম. হাফিজউদ্দিন খান।
ড. জামান বলেন, ‘‘স্কোর ও অবস্থান এই দুইয়ের মাপকাঠিতে এবং পরিবর্তিত স্কেলে বৈশ্বিক গড় স্কোর ৪৩ এর বিপরীতে বাংলাদেশের স্কোর ২৬ হওয়ায় দুর্নীতির ব্যাপকতা উদ্বেগজনক বলে প্রতীয়মান হয়। উল্লেখ্য, নি¤œক্রম অনুসারে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় সর্বনি¤œ অবস্থানে রয়েছে।”
তিনি আরো বলেন, ‘‘বাংলাদেশে দুর্নীতির ব্যাপকতা উদ্বেগজনক হলেও দুর্নীতির ধারণা সূচক থেকে মনে করার কোন কারণ নেই যে, বাংলাদেশ দুর্নীতিগ্রস্ত। যদিও দুর্নীতি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সুশাসন ও দারিদ্র্য দূরীকরণের পথে কঠিনতম অন্তরায়, তথাপি দেশের আপামর জনগণ দুর্নীতিগ্রস্ত নয়। তারা দুর্নীতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ও ভুক্তভোগী মাত্র। ক্ষমতাবানদের দুর্নীতি ও তা প্রতিরোধে দেশের নেতৃত্ব ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের ব্যর্থতার কারণে দেশ বা জনগণকে কোনোভাবেই দুর্নীতিগ্রস্ত বলা যাবে না।”
এ বছর একই স্কোর পেয়ে সিপিআই ২০১২ এ বাংলাদেশের সাথে সম্মিলিতভাবে তালিকার নিম্নক্রম অনুযায়ী ত্রয়োদশ স্থানে আরও রয়েছে ক্যামেরুন, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক, কঙ্গো রিপাবলিক, সিরিয়া ও ইউক্রেইন।
২০১২ সালে সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত তালিকার শীর্ষে যৌথভাবে অবস্থান করছে ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ড, যাদের প্রত্যেকের স্কোর ৯০। ৮৮ স্কোর পেয়ে তালিকার দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে সুইডেন এবং তৃতীয় স্থানে রয়েছে সিঙ্গাপুর যার স্কোর ৮৭। ৮ স্কোর পেয়ে ২০১২ সালে তালিকার সর্বনিম্নে অবস্থান করছে সম্মিলিতভাবে সোমালিয়া, উত্তর কোরিয়া ও আফগানিস্তান। ১৩ ও ১৫ স্কোর পেয়ে তালিকার সর্বনিম্নের দ্বিতীয় ও তৃতীয় দেশ হিসেবে রয়েছে যথাক্রমে সুদান ও মায়ানমার।
এ বছর সিপিআই নির্ণয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল নির্ণয়ন পদ্ধতির ক্রমবর্ধমান উৎকর্ষতা ও সূচকের সহজতর বোধগম্যতার জন্য নতুন স্কেল ব্যবহার করেছে। ১৯৯৫ সাল থেকে ব্যবহৃত ০-১০ এর স্কেলের পরিবর্তে দুর্নীতির ধারণার মাত্রাকে ০-১০০ এর স্কেলে দেখানো হয়েছে। এই পদ্ধতি অনুসারে এবার স্কেলের ০ অবস্থানকে দুর্নীতির ব্যাপকতার ধারণায় সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত এবং ১০০ অবস্থানকে দুর্নীতির ব্যাপকতার ধারণার মাপকাঠিতে সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত বা সর্বোচ্চ সুশাসন প্রতিষ্ঠিত দেশ বলে ধারণা করা হয়।
সিপিআই ২০১২ এর জন্য বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তথ্যসূত্র হিসেবে ৭টি প্রতিষ্ঠানের যথাক্রমে: বার্টেলসমান ফাউন্ডেশন কর্তৃক পরিচালিত ট্রান্সফরমেশন ইনডেক্স ২০১২, ইকোনোমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট কর্র্তৃক পরিচালিত কান্ট্রি রিস্ক রেটিংস্, গ্লোবাল ইনসাইটের কান্ট্রি রিস্ক রেটিংস্, পলিটিক্যাল রিস্ক সার্ভিসেস এর ইন্টারন্যাশনাল কান্ট্রি রিস্ক গাইড, বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি পলিসি অ্যান্ড ইনস্টিটিউশনাল অ্যাসেসমেন্ট ২০১১, ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরামের এক্সিউকিউটিভ ওপিনিয়ন সার্ভে ২০১২ এবং ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্ট পরিচালিত রুল অব ল ইনডেক্স এর রিপোর্টসমূহ জরিপে ব্যবহৃত হয়েছে ।
উল্লেখ্য, সিপিআই নির্ণয়ে টিআইবি কোনো ভূমিকা পালন করে না। এমনকি টিআইবি’র গবেষণা থেকে প্রাপ্ত কোনো তথ্য বা বিশ্লেষণ সিপিআই-এ প্রেরণ করা হয় না। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের টিআই চ্যাপ্টারের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। অন্যান্য দেশের টিআই চ্যাপ্টারের মতই টিআইবি সিপিআই সূচক স্থানীয় পর্যায়ে প্রকাশ করে মাত্র।
টিআইবি মনে করে, গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোগুলোর সাথে সরকারকে কথায় ও কাজে সর্বক্ষেত্রে গণতন্ত্রের সঠিক ও নিয়মিত চর্চায় আরো অধিক যত্নবান হতে হবে যাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়, জবাবদিহতা নিশ্চিত হং এবং এর ফলে দেশব্যাপী দুর্নীতির প্রকোপ হ্রাস পায়। আর এজন্য প্রয়োজন শুধু রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং তার কার্যকর প্রয়োগ।