টিআইবি’র অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা পুরস্কার ২০১২
অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে সুশাসন প্রতিষ্ঠার অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের ওপর গুরুত্বারোপ
ঢাকা, ০৪ ডিসেম্বর ২০১২ মঙ্গলবার: ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর ২০১২ সালে আয়োজিত দুর্নীতি বিষয়ক অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা পুরস্কার প্রদান করা হয়েছে। এবারের অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় প্রিন্ট মিডিয়া জাতীয় বিভাগে দৈনিক যুগান্তরের প্রাক্তন প্রতিবেদক বর্তমানে দৈনিক সকালের খবরে কর্মরত বকুল আহমেদ, প্রিন্ট মিডিয়া আঞ্চলিক বিভাগে চাঁদপুর থেকে প্রকাশিত দৈনিক ইলশেপাড় এর প্রধান প্রতিবেদক রেজাউল করিম এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া বিভাগে এটিএন নিউজের প্রাক্তন প্রতিবেদক বর্তমানে একাত্তর টিভিতে কর্মরত হোসেন সোহেল বিজয়ী হন। টিভি প্রতিবেদনটি সাহসিকতার সাথে ক্যামেরায় ধারণের জন্য এটিএন নিউজের প্রাক্তন ফটোগ্রাফার এবং বর্তমানে চ্যানেল ২৪ এ কর্মরত কৃষ্ণ সরকারকে বিশেষ সম্মাননা দেয়া হয়। প্রতিযোগিতায় প্রতিবেদকদের কাছ থেকে প্রাপ্ত ২০১১ সালে প্রকাশিত বা প্রচারিত প্রতিবেদনগুলোর মূল্যায়ন অনুযায়ী এর ঘোষণা করা হয়।
ঢাকার মহাখালীস্থ ব্র্যাক সেন্টার-এ আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্যানেল আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মতিউর রহমান- সম্পাদক, দৈনিক প্রথম আলো; অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী- রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এবং মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল- প্রধান সম্পাদক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, বৈশাখী টেলিভিশন। আলোচনা পর্বে বক্তারা অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার গুণগত মান বজায় রাখা এবং একে সুশাসন প্রতিষ্ঠার অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
উক্ত অনুষ্ঠানে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় বিজয়ী প্রত্যেকের হাতে সম্মাননাপত্র, ক্রেস্ট ও আশি হাজার টাকার চেক এবং ক্যামেরাপারসনের জন্য পঞ্চাশ হাজার টাকার চেক তুলে দেয়া হয়। টিআইবি ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল এর সভাপতিত্বে “অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা: সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ” শীর্ষক আলোচনা ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা পুরস্কার ২০১২ অনুষ্ঠানে বিভিন্ন গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
প্যানেল আলোচনায় রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বলেন “অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার অন্যতম কাজ হলো সুশাসন, মানবাধিকার রক্ষা এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সরকারের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা।” অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় আগ্রহী সাংবাদিকদের কাজের উৎকর্ষ সাধনে সুশীল সমাজের সহযোগিতার উল্লেখ করে তিনি এদেশের সাংবাদিকদের আরো স্বাধীন ও দায়িত্বশীলতার সাথে কাজ করার আহ্বান জানান।
বৈশাখী টেলিভিশন এর প্রধান সম্পাদক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল বলেন, “সাংবাদিকতার শাস্ত্রীয় দিক হচ্ছে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা। আধুনিক সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে তথ্য ও প্রযুক্তিগতভাবে যুগোপযোগী থাকার প্রয়োজন রয়েছে। আমাদের দেশে সংবাদ মাধ্যমগুলোতে সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠানের দৃঢ়তা ও মালিক পক্ষের কাজের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে তরুণ সাংবাদিকদের ভালো সাংবাদিক হয়ে ওঠার সুযোগ রয়েছে।”
পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিকদের অভিনন্দন জানিয়ে দৈনিক প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন “অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে সততা, নিষ্ঠা, পরিশ্রম ও সাহসিকতার বিকল্প নেই। আর সততা, যোগ্যতা ও দক্ষতার উপর গুরুত্ব দিতে হবে।” পাশাপাশি তিনি সাংবাদিকতার পথকে সহজ ও সম্প্রসারিত করার জন্য প্রকাশক ও সম্পাদকদের প্রশিক্ষণের বিষয়ে অভিমত প্রদান করেন।
টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “বাংলাদেশের গণমাধ্যম কর্মীরা তাদের মেধা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির বিভিন্ন দিক তুলে ধরে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় কার্যকর ভূমিকা পালন করছেন।” তিনি অধিকতর উৎকর্ষতা অর্জনে সততা, নিষ্ঠা, স্বচ্ছতা এবং সাহসিকতার সাথে সাংবাদিকদের সজাগ দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানান।
সভাপতির বক্তব্যে অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, “পেশার প্রতি যদি ভালবাসা, নিষ্ঠা না থাকলে ভাল পেশাদার সাংবাদিক হওয়া সম্ভব নয়।” তিনি সততা, যোগ্যতা, দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে দেশের সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সাংবাদিকদের কাজ করার আহ্বান জানান।
এবারের অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় প্রিন্ট মিডিয়া জাতীয় বিভাগে বিজয়ী হয়েছেন বর্তমানে দৈনিক ‘সকালের খবর’ এ প্রতিবেদক হিসেবে কর্মরত বকুল আহমেদ। তাঁর প্রতিবেদনের শিরোনাম ‘দুর্নীতির সাজানো বাগান বিআরটিএ’। দৈনিক ‘যুুগান্তর’ এ থাকাকালীন ২০১১ সালের ৭ থেকে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে এ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনটিতে পরিবহন খাতে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ)’র নানা অনিয়ম আর দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরা হয়। গাড়ির নিবন্ধন, ড্রাইভিং লাইসেন্স, ফিটনেস সনদ, রুট পারমিটসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ক্ষমতার অপব্যবহার এবং দীর্ঘদিনের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিশ্লেষণ করা হয় প্রতিবেদনটিতে।
প্রিন্ট মিডিয়া আঞ্চলিক বিভাগে বিজয়ী হয়েছেন চাঁদপুর থেকে প্রকাশিত দৈনিক ‘ইল্শেপাড়’ এর প্রধান প্রতিবেদক রেজাউল করিম। তাঁর প্রতিবেদনের শিরোনাম ‘সরেজমিন চাঁদপুর ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতাল’। ২০১১ সালের ১ থেকে ২৩ মে পর্যন্ত চাঁদপুর জেনারেল হাসপাতালের ওপর তাঁর ধারাবাহিক ১৭টি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এর মাধ্যমে সরকারি হাসপাতালটির ব্যবস্থাপনা কমিটি নিষ্ক্রিয়তা, চিকিৎসকদের অনিয়ম, চিকিৎসা-সরঞ্জাম ও এ্যাম্বুলেন্স অব্যবস্থাপনা এবং সর্বোপরি জনদুর্ভোগের ধারাবাহিক বিশ্লেষণ প্রকাশিত হয়েছে।
ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া বিভাগে বিজয়ী হয়েছেন বর্তমানে একাত্তর টিভিতে কর্মরত প্রতিবেদক হোসেন সোহেল। তাঁর প্রতিবেদনের শিরোনাম ‘সুন্দরবন ও টাইগার’। ‘এটিএন নিউজ’ এ প্রতিবেদক হিসেবে থাকাকালীন ২০১১ সালের ১ থেকে ১১ জানুয়ারী পর্যন্ত তার এ ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এর ৭টি পর্বে মূলত রয়েল বেঙ্গল টাইগারের জন্য অভয়ারণ্য- সুন্দরবনে বাঘের আশংকাজনক সংখ্যা হ্রাসের দিকে আলোকপাত করা হয়েছে। এতে সুন্দরবন রক্ষায় বনবিভাগের দুর্বল ব্যবস্থাপনা, সুন্দরবন সংশ্লিষ্ট চোরা বাঘ শিকারী ও পাচারকারী চক্রের অবৈধ তৎপরতার উদ্বেগজনক পরিস্থিতি ও বাস্তব অবস্থা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। একই প্রতিবেদনে ক্যামেরায় সাহসি সহযোগিতার জন্য বর্তমানে চ্যানেল ২৪ এ কর্মরত কৃষ্ণ সরকার পুরস্কৃত হয়েছেন।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে দুর্নীতি বিষয়ক অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় পেশাদারী উৎকর্ষ সাধনের লক্ষ্যে ১৯৯৯ সাল থেকে প্রতি বছর টিআইবি এ পুরস্কার প্রদান করে আসছে। এবার প্রিন্ট মিডিয়ায় জাতীয় বিভাগে ৪৪টি, আঞ্চলিক বিভাগে ১৫টি এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় ৯টিসহ মোট ৬৮টি প্রতিবেদন জমা পড়ে। মুলত ১ জানুয়ারী ২০১১ থেকে ৩১ ডিসেম্বর ২০১১ সময় পর্যন্ত প্রকাশিত বা প্রচারিত সংবাদগুলোই কেবল মূল্যায়ন করা হয়েছে।
প্রতিবেদনগুলো মূল্যায়নের জন্য চার সদস্যের বিচারকমন্ডলীতে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সুপারনিউমেরারী অধ্যাপক ড. সাখাওয়াত আলী খান, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী; গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর এবং মাস লাইন মিডিয়া সেন্টার এর নির্বাহী পরিচালক কামরুল হাসান মঞ্জু।