টিআইবি’র জাতীয় খানা জরিপ ২০১২
সেবাখাতে দুর্নীতির হার কমেছে তবে সকল গুরুত্বপূর্ণ খাতে ব্যাপকতা উদ্বেগজনক, ঘুষ আদায়ের হার বেড়েছে
ঢাকা, ২৮ ডিসেম্বর, ২০১২: জাতীয় খানা জরিপ প্রকাশ করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ(টিআইবি) বলেছে দেশের ৬৩.৭% সেবাগ্রহণকারী কোন না কোনভাবে দুর্নীতির শিকার হচ্ছেন। সেবাগ্রহণের প্রেক্ষিতে সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হল শ্রম অভিবাসন(৭৭%) এর পরেই আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা (৭৫.৮%) ভূমি প্রশাসন (৫৯%), ও বিচারিক সেবা (৫৭.১%)। সেবা গ্রহণের সময় বাংলাদেশের ৫৩.৩% খানাকে কোন না কোনখাতে নিয়ম-বহির্ভূত অর্থ দিতে হয়েছে যার গড় ১৩,০৮৪ টাকা। জরিপকৃত সকল খানার জন্য নিয়ম-বহির্ভূত এই অর্থের গড় ৬৯০০ টাকা। এই ভিত্তিতে প্রাক্কলনে দেখা যায় জাতীয়ভাবে প্রদত্ত মোট নিয়ম-বহির্ভূত অর্থের পরিমাণ ২১,৯৫৫.৬ কোটি টাকা। যা ২০১১-২০১২ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের ১৩.৬% এবং জিডিপি’র ২.৪%।
সকালে সিরডাপ মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় খানা জরিপ ২০১২ এর ফল প্রকাশ করে টিআইবি জানায় দেশের ১৩টি সুনির্দিষ্ট সেবাখাতের দুর্নীতির সার্বিক পরিসি'তি ২০১০ সালের ৮৪.২ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে এ বছর ৫৫.৮ শতাংশে উপনীত হলেও বর্তমানে সেবাগ্রহীতারা অধিকহারে নিয়ম-বহির্ভূত অর্থ প্রদানে বাধ্য হচ্ছেন।
সংবাদ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন টিআইবি’র বোর্ড অব ট্রাস্টিজ এর চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান । প্রতিবেদন উপস্থান করেন মো. রফিকুল হাসান, পরিচালক-গবেষণা ও পলিসি বিভাগ, ও শাহজাদা এম আকরাম সিনিয়র গবেষণা ফেলো, টিআইবি।
অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল তাঁর বক্তব্যে বলেন,‘‘যখন সেবাগ্রহণের হার উল্লেখযোগ্য হারে কম হয় তখন এটি প্রতীয়মান হয় যে, আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো যথেষ্ঠ মাত্রায় সেবামুখী ও শক্তিশালী হয়ে ওঠেনি, এর ফলে জনসাধারণের মধ্যে প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয় এবং তারা নানাবিধ বিকল্প উপায়ে সেবা নিতে গিয়ে দুর্নীতির শিকার হন, মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়, ক্ষমতার অপব্যবহারের সুযোগ তৈরি যা মূলত সুশাসনকে বাধাগ্রস্ত করে।”
২০১২ সালের জাতীয় খানা জরিপ অনুযায়ী স্বাস্থ্যখাতে ৪০.২%, শিক্ষাখাতে ৪০.১% এবং স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে দুর্নীতির শিকার হওয়ার হার ৩০.৯%। উল্লেখ্য, খাতওয়ারী হারের ক্ষেত্রে কৃষিতে ২০.৪%, বিদ্যুৎ-খাতে ১৮.৩%, কর ও শুল্ক খাতে ১৬.৮%, ব্যাকিং সেবায় ৭.১%, বীমা খাতে ৬%, এনজিও খাতে ৫% এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে (যেমন; বিআরটিএ, ওয়াসা, পাসপোর্ট, বিটিসিএল, ডাক ও নিয়োগ, বদলী, পদোন্নতি) দুর্নীতির শিকার হওয়ার হার ৪১.১%।
২০১০ এর জাতীয় খানা জরিপের সাথে ২০১২ সালের তুলনামূলক চিত্রের বিশ্লেষণে দেখা যায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, ভূমি প্রশাসন, বিচারিক সেবা, কৃষি, বিদ্যুৎ, কর ও শুল্ক, শিক্ষা, ব্যাংকিং, বীমা ও এনজিও খাতে আগের তুলনায় দুর্নীতির হার কমলেও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, ভূমি প্রশাসন, বিচারিক সেবা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের মত খাতে দুর্নীতির ফলে মানুষের হয়রাণির অভিজ্ঞতা এখনো সবচেয়ে বেশি। শুধু স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতি ২০১০ সালের ৩৩.২% শতাংশ থেকে বেড়ে ৪০.২% এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে ২০১০ এর ৩৪.১% তুলনায় দুর্নীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৪.৯%।
প্রতিবেদন অনুযায়ী ভৌগলিক অবস্থানভেদে দুর্নীতির মাত্রা গ্রামাঞ্চলে বেশি, যা এ সমস্যার গভীরতা ও ব্যাপকতার উদ্বেগজনক অবস্থার প্রতিফলন। বাংলাদেশে ঘুষ ও নিয়ম বহির্ভূত অর্থের পেছনে খানাপ্রতি বার্ষিক গড় ব্যয়ের ৪.৮% খরচ হয়, তবে নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর জন্য দুর্নীতির প্রভাব তুলনামূলকভাবে বেশি ( মোট ব্যয়ের ৫.৫%), পক্ষান্তরে ধনীদের জন্যে তা তুলনামূলক কম ( মোট ব্যয়ের ১.৩%)। অর্থাৎ দুর্নীতির কারণে বিপুল ক্ষতির বোঝা আপেক্ষিক অর্থে দরিদ্র জনগণের ওপরেই বেশি।
উল্লেখ্য, ১৯৯৭ সাল থেকে টিআইবি এ পর্যন্ত ৬টি খানা জরিপ পরিচালনা করেছে। ২০১২ সালের জরিপে সেবা নেয়ার সময়কাল ২০১১ সালের মে থেকে ২০১২ সালের এপ্রিল পর্যন্ত। জরিপের তথ্য সংগৃহীত হয়েছে ১৫ মে থেকে ৪ জুলাই ২০১২ পর্যন্ত। জরিপের বৈজ্ঞানিক মান নিশ্চিতকল্পে কঠোর প্রশাসনিক পদক্ষেপের পাশাপাশি ছয়জন জাতীয়-আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিশেষজ্ঞের একটি দলের সহায়তা ও পরামর্শ গ্রহণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এর Integrated Multi-Purpose Sampling পদ্ধতি ব্যবহার করে এই জরিপটি পরিচালিত হয়েছে। গ্রামীণ এলাকায় ৬০% এবং শহর এলাকায় ৪০% নমুনা ধরে বিভিন্ন স্তরে খানা নির্বাচনের ক্ষেত্রে নির্ধারিত স্তরের মোট খানাকে square root transformation করে নমুনার আকার ৭০০০ নির্ধারণ করা হয়েছে এবং non-response এর জন্যে সমন্বয় করে মোট জরিপকৃত খানার সংখ্যা ৭৯০৬ টি। তার মধ্যে ইউনিয়ন পরিষদ ৪৬২৪ (৫৮.৫%), পৌরসভা ১৯৮১(২৫%),statistical Metropolitan area (এসএমএ) ১৩০১(১৬.৫%)। খানা নির্বাচনের জন্য দৈবচয়নের মাধ্যমে ৬৪ জেলা থেকে মোট ৩৫০ পিএসইউ নির্বাচন করা হয় এর পরে দ্বিতীয় পর্যায়ে পিএসইউ সংশ্লিষ্ট গ্রাম বা মহল্লাকে কয়েকটি segment এ ভাগ করা হয় এবং পুনরায় দৈবচয়নের মাধ্যমে ১০০ খানার তালিকা তৈরি করে সেই ১০০ খানা থেকে systematic sampling এর মাধ্যমে ইউনিয়ন পরিষদে ২২ টি, পৌরসভায় ২৩টি ও সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ২৫টি করে খানা নির্বাচন করা হয়। খানাজরিপে তথ্যদাতার ধরনের মধ্যে খানাপ্রধান ৬৬.৩%, পরিবারের অন্যান্য সদস্য ৩৩.৭%, ৩৫.৮% নারী এবং ৬৪.২% পুরুষ।
২০১০ এর তুলনায় ২০১২ সালে স্বাস্থ্যখাত ছাড়া প্রায় প্রতিটি খাতেই দুর্নীতি ও হয়রানি কমার পেছনে যেসকল কারণের অবদান থাকতে পারে বলে ধারণা করা যায় সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল; জনগণের মধ্যে দুর্নীতিবিরোধী সচেতনতা বৃদ্ধি, কোনো কোনো সেবা খাতে তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধমে সেবা গ্রহণ প্রক্রিয়া সহজতরকরণ, সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতিবিরোধী প্রশিক্ষণ, কোনো কোনো স্থানীয় সরকার পর্যায়ে জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্বশীল ভূমিকা এবং সর্বোপরি নাগরিক সমাজ, এনজিও ও গণমাধ্যমে দুর্নীতিবিরোধী সক্রিয় প্রচারণার ফলে সার্বিকভাবে জনসচেতনতা ও দুর্নীতিবিরোধী অবস্থান গ্রহণের সুযোগ, তথ্য প্রবাহ বৃদ্ধি এবং স্থানীয় পর্যায়ে সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে জন অংশগ্রহণ বৃদ্ধি ।
জরিপের ফলাফল ও পর্যবেক্ষণ বিশ্লেষণপূর্বক প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে, নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে, সচেতনতা, প্রচারণা ও অ্যাডভোকেসি সংশ্লিষ্ট কিছু সুপারিশ উপস্থাপন করেছে টিআইবি যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল; সেবাখাতে তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি, প্রণোদনা প্রদান, দুর্নীতির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ ও দক্ষতা বৃদ্ধি, তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ ও তথ্য প্রকাশকারীর সুরক্ষা আইন ২০১১ এর কার্যকর বাস্তবায়ন,স্বাধীন ও শক্তিশালী দুদক গঠন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাতীয় সংসদ ও মন্ত্রণালয়ের তদারকি বৃদ্ধি, জাতিসংঘ দুর্নীতিবিরোধী সনদ বাস্তবায়ন, নাগরিক সমাজ প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমের ভূমিকা বৃদ্ধি ইত্যাদি।