২০০৭-৮ তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে সেনাবাহিনীর একাংশের ক্ষমতার অপব্যবহার;
ভবিষ্যতে এক-এগারোর মত পরিস্থিতি এড়াতে গণতান্ত্রিক চর্চা ও গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের আহ্বান
ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০১৩: ভবিষ্যতে ২০০৭-৮ সালের এক এগারোর মত পরিসি'তি এড়াতে সকল রাজনৈতিক দলের সকলপর্যায়ের নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক চর্চা ও গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের ওপর গুরুত্বারোপ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। আজ ব্র্যাক সেন্টার ইন এ আয়োজিত ‘‘২০০৭-৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সশস্ত্র বাহিনী সদস্যদের একাংশের ভূমিকা” শীর্ষক এক প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ভবিষ্যতে এক এগারোর মত পরিসি'তির পুনরাবৃত্তি রোধে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি দায়িত্বশীল ও কার্যকর ভূমিকা পালনের এই আহ্বান জানানো হয়।
টিআইবি’র ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট সুলতানা কামালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন টিআইবি ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য এম. হাফিজউদ্দিন খান, টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। সংবাদ সম্মেলনে আলোচ্য গবেষণার ওপর এক উপস্থাপনা পরিবেশন করেন রেযাউল করিম, প্রোগ্রাম ম্যানেজার, গবেষণা ও পলিসি বিভাগ, টিআইবি।
সংবাদ সম্মেলনে অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, ‘‘রাজনৈতিক সংকট মোকাবেলায় সশস্ত্র বাহিনীর অনুপ্রবেশ কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারেনা। কারণ, সেনাবাহিনীর অনাকাঙ্ক্ষিত হস্তক্ষেপের ফলে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়, আইনের শাসন ব্যাহত হয় এবং গণতান্ত্রিক ধারার গতি বাধাগ্রস্ত হয়।”
এম. হাফিজউদ্দিন খান বলেন,“প্রতিরক্ষা বাহিনীর কাজ হল দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় কাজ করা, তাদের জনপ্রশাসনে কোন ভূমিকা থাকা উচিৎ নয়, এতে তাদের পেশাগত দক্ষতা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং তাদের মূল দায়িত্ব পালন ব্যাহত হয়। রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতার কারণেই সেনাবাহিনীকে দেশ পরিচালনায় হস্তক্ষেপ করতে হয়, যা আমাদের প্রত্যাশিত নয়।’’
ড. ইফতেখারুজ্জামান তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘‘গণতন্ত্রের কোন বিকল্প নেই, যদি থাকে তা হল আরো উন্নততর গণতন্ত্র। কোন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়ই সশস্ত্র বাহিনী জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে নয়। সেনাবাহিনী বেসামরিক কার্যক্রমে জড়িত হলে কী ধরনের ক্ষমতার অপব্যবহারের সুযোগ ও ঝুঁকি সৃষ্টি হয়, তা বিশদভাবে জানতে টিআইবি এই গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। ভবিষ্যতে তথাকথিত এক-এগারো এড়াতে গণতান্ত্রিক চর্চা ও গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের বিকল্প নেই। ”
২০০৯ সালের জুলাই থেকে ২০১২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সংগৃহীত মাঠ পর্যায়ের তথ্য, দুই শতাধিক তথ্য দাতাদের সাথে সাক্ষাৎকার, ৮টি দলীয় আলোচনা, ২০টি কেস স্টাডি এবং পরোক্ষ উৎস থেকে প্রাপ্ত তথ্যের আলোকে প্রণীত গুণগত এই গবেষণায় ২০০৭-৮ সালে সেনা সহায়তায় গৃহীত ইতিবাচক কর্মকাণ্ড এবং সেনাসদস্যদের একাংশের অনিয়ম ও দুর্নীতির ধরন ও প্রক্রিয়া পর্যালোচনা করা হয়।
গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী দুর্নীতি বিরোধী অভিযান, জাতীয় পরিচয়পত্র ও ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রকল্প বাস্তবায়ন, বিভিন্ন সেবাখাতের বকেয়া বিল আদায়, অবৈধ ভূমি দখলদারদের উচ্ছেদসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নবম জাতীয় সংসদের নির্বাচন সম্পন্নের মাধ্যমে সেনাবাহিনী সর্বমহল কর্তৃক প্রশংসিত হলেও সেনা সদস্যের একাংশের এখতিয়ার বহির্ভূত কর্মকাণ্ড, অনিয়ম ও দুর্নীতিতে সংশ্লিষ্টতার প্রেক্ষিতে সেনাবাহিনীর প্রতিষ্ঠানিক ভাবমূর্তি ব্যাপকভাবে ক্ষুণ্ন হয়।
২০০৭-৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় সেনা সদস্যদের একাংশের অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রকৃতি অনুসন্ধানে গবেষণায় ব্যবহৃত ৫টি সূচক হল: ক্ষমতার অপব্যবহার করে অর্থ-সম্পদ অর্জন,সংবিধান ও আইন লঙ্ঘন, মানবাধিকার লঙ্ঘন, প্রভাব বিস্তার এবং গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ।
প্রতিবেদন অনুযায়ী সেনাসদস্যদের একাংশের অনিয়ম ও দুর্নীতির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল: বিধি-বহির্ভূতভাবে ও জোর করে অর্থ গ্রহণ ও আদায়, বিধি-বহির্ভূতভাবে চট্টগ্রাম বন্দরে বার্থ অপারেটর নিয়োগ ও কন্টেইনার রাখার চার্জ বৃদ্ধি, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নির্যাতন, রাজনীতিকদের ওপর নির্যাতন ও হয়রানি, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি ও ঠিকাদারদের ওপর নির্যাতন; আইনি সহায়তা প্রত্যাশীদের ভয়ভীতি প্রদর্শন, প্রক্রিয়া না মেনে দ্রুত বিচার, সুপ্রিম কোর্ট ও ঢাকা বারের নির্বাচন পেছাতে বাধ্য করা,জেলখানায় ডিভিশন প্রাপ্তিতে প্রভাবিত করা, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ, গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি। সেনাসদস্যদের একাংশের অনিয়ম ও দুর্নীতির ফলে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সশস্ত্র বাহিনীর পেশাদারিত্ব ক্ষতিগ্রস্ত, বিচারিক কার্যক্রম ব্যাহত ও জনগণ সঠিক তথ্যপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে টিআইবি সাত দফা সুপারিশ উত্থাপন করে, এর মধ্যে সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করা, সেনাসদস্যদের বিরুদ্ধে গৃহীত শাস্তিমূলক ব্যবস্থার ওপর তথ্য প্রকাশ, সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার কর্মপরিধি ও এখতিয়ার সুনির্দিষ্টকরণ, বেসামরিক কাজে সশস্ত্রবাহিনীর ব্যবহার সীমিতকরণ, দায়মুক্তির সুযোগ আইনত নিষিদ্ধকরণ, অবাধ তথ্য প্রবাহ নিশ্চিতকরণ এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের সদিচ্ছা ও দায়িত্বশীল আচরণ উল্লেখযোগ্য।