বিশেষ সাক্ষাৎকারে ড. ইফতেখারুজ্জামান: অন্যায় করলেই শাস্তি পেতে হবে

প্রকাশকাল: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

. ইফতেখারুজ্জামান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক। ২০১৫ সালে তৃতীয়বারের মতো তিনি বার্লিনভিত্তিক ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের আন্তর্জাতিক পরিচালনা পর্ষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। এর আগে ২০০৮ থেকে ২০১১ এবং ২০১২ থেকে ২০১৫ মেয়াদে একই দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ২০১৫ সালে টিআইয়ের ধারণা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩তম, স্কোর ২৫ শতাংশ। স্কোর ২০১৪ সালের সমান আর অবস্থান কমেছে ২০১৪ সালের তুলনায় মাত্র এক ধাপ। দুর্নীতির ধারণা সূচক সম্পর্কে টিআইবির মন্তব্য, তাদের জরিপের পদ্ধতি, দুর্নীতি দূরীকরণে তাদের করণীয় ইত্যাদি বিষয় নিয়ে কালের কণ্ঠ’র সঙ্গে টিআইবির নির্বাহী পরিচালকের কথা হয়। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শারমিনুর নাহার

 
কালের কণ্ঠ : টিআইয়ের ধারণা সূচকে এবার বাংলাদেশের অবস্থান ১৩তম। রিপোর্টে বাংলাদেশে দুর্নীতির ‘ব্যাপকতা ও গভীরতা উদ্বেগজনক’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। এই কথাটি একটু বুঝিয়ে বলুন।
ইফতেখারুজ্জামান : ২০০১ সালে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের এই সূচকের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর থেকে পর পর পাঁচবার একেবারে সর্বনিম্নে ছিল অর্থাৎ তথাকথিত চ্যাম্পিয়ন হয়। ২০০৫ সালের পর স্কোর ও অবস্থান উভয় মাপকাঠি কিছুটা উন্নতির দিকে যেতে থাকে; যদিও এখন পর্যন্ত আমাদের প্রত্যাশিত পর‌্যায়ের উন্নতি হয়নি। এই সূচকের বৈশ্বিক গড় স্কোর ৪৩। বলা হয় যে যেসব দেশ ৪৩ বা ততোধিক স্কোর পায়, তারা দুর্নীতিকে মোটামুটি কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছে। সেই ভিত্তিতে আমাদের স্কোর এখনো যথেষ্ট ভালো নয়। দ্বিতীয়ত, এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান শুধু আফগানিস্তানের ওপরে। এ ক্ষেত্রে আফগানিস্তানের যুদ্ধবিধ্বস্ত অবস্থা বিবেচ্য, যা আমাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।
আমাদের দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের সম্ভাবনা অনেক বেশি। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে আমরা ইতিবাচক ও গৌরবময় অগ্রগতি অর্জন করেছি, যেটা দক্ষিণ এশিয়ার অন্য কোনো দেশ পারেনি। আমাদের আর্থ-সামাজিক অগ্রগতি এখন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। আমাদের জাতীয় প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের বেশি হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সব দেশের তুলনায় সামাজিক সূচকে আমরা এগিয়ে। আমরা শুধু পিছিয়ে আছি সুশাসন ও দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের মাপকাঠিতে। সুশাসন যদি নিশ্চিত করা যেত, তাহলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যেমন বাড়ত, তেমনি সামাজিক সূচকগুলো আরো বাড়ত। এটিকে বিবেচনায় নিতে হবে।
 
কালের কণ্ঠ : টিআই যে জরিপ প্রকাশ করে সেগুলো কোন কোন সূচকের ভিত্তিতে করা হয়? তথ্যগুলো কোন খাত থেকে ও কোন প্রক্রিয়ায় নেওয়া হয়েছে?
ইফতেখারুজ্জামান : মূলত সরকারি খাত, দুর্নীতির ব্যাপকতা সম্পর্কে তথ্য প্রদানকারীদের ধারণা, তথ্যের পরিমাপ ও বিশ্লেষণ করে এ সূচকটি তৈরি হয়। এখানে মূলত রাষ্ট্রীয় সেবা খাতগুলোকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। অর্থাৎ সাধারণ মানুষ সরকারের সেবা নিতে গিয়ে যে প্রতিবন্ধকতা বা হয়রানির মুখোমুখি হয়েছে, অবৈধ লেনদেন করতে হয়েছে—এমন বিষয়গুলো জরিপে বিবেচিত হয়। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ খাত, যেমন- প্রশাসন, আইনের প্রয়োগ, কর আদায় ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে দুর্নীতির তথ্য এই সূচকে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। অন্যদিকে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সরকারের আইনি, প্রাতিষ্ঠানিক ও নীতি কাঠামো কতটুকু দুর্নীতি প্রতিরোধে সহায়ক ও কার্যকর তার মূল্যায়নও এই সূচকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
 
কালের কণ্ঠ : এসব তথ্য কোন পদ্ধতিতে যাচাই-বাছাই করা হয় সে সম্পর্কে একটু বলুন।
ইফতেখারুজ্জামান : পদ্ধতির ক্ষেত্রে প্রথমেই মনে রাখতে হবে এটি একটি আন্তর্জাতিক জরিপ। বার্লিনে টিআইয়ের আন্তর্জাতিক সদর দপ্তরে এটি প্রণীত হয় প্রতিবছর ১০ বা ১২টি আন্তর্জাতিক জরিপের তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে। টিআইবি, অর্থাৎ টিআইয়ের বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের কোনো গবেষণা, জরিপ বা তথ্য এই সূচকে যায় না। কারণ আমাদের তথ্যগুলো জাতীয় তথ্য, অন্য দেশের অবস্থার সঙ্গে তুলনার যোগ্য নয়। এ সূচকে শুধু সেই তথ্যগুলোই যায়, যেগুলো আন্তর্জাতিক তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরে। যে তথ্য অন্য দেশের সঙ্গে তুলনার ক্ষেত্রে কাজে লাগে না, সেই তথ্য এখানে অন্তর্ভুক্ত হয় না। এই বিবেচনা থেকে শুধু আন্তর্জাতিক সুখ্যাতিসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান কর্তৃক পরিচালিত জরিপ আন্তর্জাতিকভাবে তুলনাযোগ্য তথ্য সংগ্রহ করা হয়। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল সচিবালয়ের গবেষণা বিভাগে সামাজিক বিজ্ঞান ও জরিপ-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত স্কোর ও র‍্যাংকিং পদ্ধতি অবলম্বন করে সূচকটি নিরূপণ করা হয়। তথ্যের নির্ভরযোগ্যতা নিরপেক্ষভাবে যাচাই-বাছাই করা হয়। এ জন্য একে বলা হয় জরিপের ওপর জরিপ। টিআইয়ের পক্ষ থেকে চেষ্টা করা হয় সর্বোচ্চ পর‌্যায়ে পদ্ধতিগত নিরপেক্ষতা, গ্রহণযোগ্যতা ও যৌক্তিকতা নিশ্চিত করার। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়সহ আন্তর্জাতিক কিছু গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বিশেষজ্ঞরা স্কোর ও র‍্যাংকিংয়ের পদ্ধতিগত উত্কর্ষ নিশ্চিতের লক্ষ্যে টিআইকে পরামর্শ দিয়ে থাকে।
 
কালের কণ্ঠ : টিআইয়ের তথ্য সংগ্রহ বা যাচাই-বাছাইয়ের প্রক্রিয়া নিয়ে অনেক সমালোচনা আছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে আপনার বক্তব্য কী?
ইফতেখারুজ্জামান : হ্যাঁ, এটি এখন একরকম স্বাভাবিক চর্চায় পরিণত হয়েছে। আমরা যতই বলি না কেন যে সামাজিক ও জরিপ বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়, তা অনেকের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না। আরেকটি সমালোচনা হলো, আমাদের গবেষণা সংবাদমাধ্যমনির্ভর, তাই গ্রহণযোগ্য নয়। এর জবাবে বলব, আমরা কোনো গবেষণা বা জরিপের জন্য সংবাদমাধ্যমের ওপর নির্ভরশীল নই। তথ্য সংগ্রহের অনেক সূত্রের মধ্যে কোনো কোনো ক্ষেত্রে একটি হচ্ছে সংবাদমাধ্যম। আর এটাও বলতে চাই, যাঁরা সংবাদপত্র থেকে নেওয়া তথ্যের সমালোচনা করেন তাঁরা আদতে সংবাদমাধ্যমকেই অবমূল্যায়ন করেন। কারণ সংবাদমাধ্যমের তথ্য গ্রহণযোগ্য হবে না এটা বলার ভিত্তি নেই। আমরা যারা সংবাদপত্র পড়ি, আবার সেটারই সমালোচনা করি। এগুলোর সবই কিন্তু সংবাদমাধ্যমের ফলেই আবার উঠে আসে। তাহলে আমার কথাটা কি যথার্থ নয়? আমরা প্রত্যক্ষভাবে জরিপ না করে সংশ্লিষ্ট মানুষের সঙ্গে কথা বলে, তথ্য সংগ্রহ না করে কোনো কাজ করি না। তবে আরেকবার বলছি, আমাদের যে গবেষণা, তথ্যভাণ্ডার তার কোনোটিই টিআই প্রণীত দুর্নীতির ধারণা সূচকে যায় না। তারা এর আগে উল্লিখিত আন্তর্জাতিক জরিপ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে। আর তাদের সেই গবেষণার ফল এই সূচকটি স্থানীয়ভাবে আমরা প্রকাশ করি মিডিয়ার মাধ্যমেই।
 
কালের কণ্ঠ : অর্থের উৎস নিয়ে টিআইবির সমালোচনা করেন অনেকে। একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর অর্থায়নে, তাদের নিজস্ব আগ্রহে টিআইবি কাজ করে থাকে বলে অনেকে মনে করেন। এ সম্পর্কে কী বলবেন?
ইফতেখারুজ্জামান : বলার অধিকার সবারই আছে। আমাদের কাজের বিষয়বস্তু এমন যে এ ধরনের মন্তব্য শোনার জন্য আমাদের প্রস্তুতই থাকতে হয়। যাঁরা ক্ষমতায় থাকেন সব সময় তাঁদের একাংশ আমাদের কাজের সমালোচনা করেন আর যাঁরা বিরোধী দলে থাকেন তাঁরা সাধুবাদ দেন। এটা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা এটাকে পেশাগত বিড়ম্বনা বলেই মনে করি। হয়তো বা আমাদেরও ব্যর্থতা আছে যে আমরা পুরোপুরি তাঁদের বোঝাতে পারছি না। তবে এটা নিশ্চিত যে এ ধরনের বক্তব্যে রাজনৈতিক উপাদান প্রাধান্য পায়। এটা শুধু আমি বলছি না, অনেক রাজনীতিবিদও বলে থাকেন। কাজের অভিজ্ঞতায় এমন অনেক উদাহরণ জমা হয়েছে। সংসদে একবার খুব তীব্র আলোচনা হচ্ছিল টিআইবিকে বন্ধ করে দিতে হবে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বর্ষীয়ান একজন রাজনীতিবিদ এক সমাবেশে বলেছিলেন, টিআইবি তো সব সময়ই প্রতিবেদন দিয়ে থাকে। যখন আমরা সরকারি দলে থাকি তখন বলি ‘ওয়াসতাগফিরুল্লাহ’ আর যখন বিরোধী দলে থাকি তখন বলি ‘আলহামদুলিল্লাহ’। এটাই একদিক থেকে আমাদের প্রতিবেদনের গ্রহণযোগ্যতার দৃষ্টান্ত। কারো প্রভাবে আমরা প্রভাবিত নই। যেসব প্রতিষ্ঠান আমাদের অর্থ সহায়তা দিয়ে থাকে, তারা সরকারের সুপরিচিত। সরকারি অনুমোদন ছাড়া একটা টাকাও আমরা গ্রহণ করতে বা ব্যয় করতে পারি না। আমরা সরকার কর্তৃক নিবন্ধিত একটি প্রতিষ্ঠান, সরকারের অনুমতি সাপেক্ষেই আমাদের কার্যক্রম পরিচালিত হয়। আমরা সব সময় আইন মেনে চলি। আমাদের অর্থের সোর্সগুলো ওয়েবসাইটে প্রকাশিত আছে। মূলত চারটি দেশের সরকারি ফান্ড থেকে টিআইবির অর্থ আসে। এগুলো হলো ব্রিটিশ সরকার, ডেনিশ সরকার, সুইডিশ সরকার ও সুইস সরকার। এই চারটি দেশের করদাতাদের কাছ থেকে সংগৃহীত অর্থ আমরা পেয়ে থাকি। সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ ডেনমার্ক, যাদের স্কোর এবার ১ পয়েন্ট কমেছে। যদি এমনটা হতো, তাহলে কিন্তু তারা স্কোর বাড়িয়ে নিতে পারত। আমরা এটুকু মেনে নিই যে আমাদের সমালোচনা হতেই পারে। তবে আমরা কোনো পক্ষ দ্বারা প্রভাবিত তা মেনে নেব না; আমরা কেবল আমাদের জাতীয় স্বার্থ দ্বারা প্রভাবিত—এটুকু বলব গর্বের সঙ্গে। অন্য কোনো মহল বা উদ্দেশ্যে আমরা প্রভাবিত নই বলেই আমরা টিকে আছি, ভালো আছি।
 
কালের কণ্ঠ : দুর্নীতিবিরোধী সূচকের মাধ্যমে আপনারা আগে দুর্নীতির কারণ ও এর পরে সমাধানের পথ বাতলে দেন। এতে আমরা কতখানি লাভবান হয়েছি? আশাবাদের জায়গাগুলো কী?
ইফতেখারুজ্জামান : আমি খুব আশাবাদী মানুষ। আমাদের সফলতা অনেক। আমরা রাষ্ট্রের আইনি, প্রাতিষ্ঠানিক ও নীতি-কাঠামো শক্তিশালী করতে অবদান রাখতে পেরেছি। সরকারের সঙ্গে অনেক কাজ করেছি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে। অনেক সুফল নিয়ে আসতে পেরেছি। এটা একদিক থেকে আমাদের সন্তুষ্টি, অন্যদিক থেকে উত্কণ্ঠাও। সন্তুষ্টি এ কারণে যে আমাদের কাজের ফলে বাংলাদেশে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দুদক যতই বিতর্কিত হোক না কেন, টিআইবি কিন্তু দুদকের স্বাধীনতা ও কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে দুদক ও সরকারের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশ আজকে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী কনভেনশনের সদস্য রাষ্ট্র। এই সদস্য রাষ্ট্র হওয়ার দাবিটা আমরা একটি গবেষণাকাজের মাধ্যমে সরকারের কাছে তুলে ধরি। তিন বছর ধরে সরকারের সঙ্গে অ্যাডভোকেসি করার প্রক্রিয়ায় এটা সম্ভব হয়েছে। এরই মধ্যে এর সুফলও পাওয়া যাচ্ছে। যেমন সিঙ্গাপুর থেকে পাচার হয়ে যাওয়া অর্থ দেশে ফেরত এসেছে। এর অন্যতম কারণ আমরা জাতিসংঘের সেই কনভেনশনের সদস্য। এ কারণে সরকার সক্রিয় হলে মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম প্রকল্পের সুবিধাভোগী থেকে শুরু করে সুইস ব্যাংকে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনা যাবে এবং যারা অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত তাদের বিচারের আওতায় আনা যাবে।
এ ছাড়া ‘তথ্য অধিকার আইন’-এর খসড়া তৈরি থেকে শুরু করে আইনটির প্রণয়নপ্রক্রিয়ায় আমরা প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করেছি। আইনটি বাস্তবায়নের জন্য সরকারের সহায়ক হিসেবে কাজ করছি। একইভাবে ‘তথ্য প্রকাশকারী সুরক্ষা আইন’ ও জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলের খসড়া প্রণয়নে অবদান রাখতে পেরেছি। শুদ্ধাচার কৌশল নিয়ে আমরা খুবই গর্বিত ও আশাবাদী। বিশ্বের খুব কম দেশেই এটি রয়েছে। বহু সফলতা আমাদের। কিন্তু উত্কণ্ঠা হলো, আইন, নীতি, সবই হয়ে আছে, তবে এগুলো যে যার জায়গায় বসে আছে। এগুলোর কোনো সুফল আমরা পাচ্ছি না। আইন, নীতি প্রয়োগ করতে আমরা ব্যর্থ হচ্ছি। সরকার যদি এটুকু অন্তত নিশ্চিত করতে পারত যে দুর্নীতি যে-ই করুক না কেন তাকে শাস্তি পেতে হবে, তাহলে আমরা অনেক দূর যেতে পারতাম।
 
কালের কণ্ঠ : সরকারের ডিজিটাইজেশন প্রকল্প দুর্নীতির ক্ষেত্রে কতখানি সাফল্য বয়ে আনতে পারবে?
ইফতেখারুজ্জামান : সরকার দুর্নীতি দূর করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। ভিশন ২০২১-এর অন্যতম উপাদান ডিজিটাল বাংলাদেশ। এর কার্যকর বাস্তবায়ন দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে অমূল্য অবদান রাখতে পারে। এরই মধ্যে কোনো কোনো সেবা খাতে এর সুফল পাওয়া যাচ্ছে। ভূমি ব্যবস্থাপনাকে পরিপূর্ণ ডিজিটাইজেশনের আওতায় আনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ভূমি খাতে দুর্নীতির ফলে দেশের প্রায় প্রত্যেক নাগরিক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত।
বর্তমান সরকারের সফলতা অনেক। কিন্তু তার পরও আমরা সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের মাপকাঠিতে উদ্বেগজনকভাবে পিছিয়ে আছি। সংসদে নামমাত্র বিরোধী দল। তারা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। সংসদীয় কমিটিগুলো কার্যকর নয়। অনেক কমিটি বিধি অনুযায়ী মাসে একটি বৈঠকও করতে পারে না। বৈঠক করলেও তার সুফল বিরল। কমিটিগুলোর মধ্যে অনেকেরই অন্যতম দুর্বলতা স্বার্থের দ্বন্দ্ব। যদি দুর্নীতি দূর করার জন্য কোনো বুলেট ম্যাজিক থাকে, তাহলে বলব অপরাধ করলেই শাস্তি পেতে হবে, এটা কার্যকর করুন।
 
কালের কণ্ঠ : সাধারণ মানুষ যারা দুর্নীতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তাদের জন্য কিছু বলার আছে কি?
ইফতেখারুজ্জামান : টিআইয়ের সাম্প্রতিক একটি বৈশ্বিক জরিপে দেখা যায় সারা বিশ্বের ৬০ শতাংশ মানুষ দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে আগ্রহী। অন্যদিকে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই হার ৯০ শতাংশের বেশি। সুতরাং আমাদের আশাবাদী হতেই হবে। আমাদের মানুষের ন্যায্যতা বোধ অনেক ভালো। যারা দুর্নীতি করে তাদের বৃহৎ অংশই নিরুপায় হয়ে দুর্নীতির আশ্রয় নেয়। উপযাচক হয়ে দুর্নীতি করে এমন মানুষের হার তুলনামূলকভাবে অনেক কম। এই পরিপ্রেক্ষিতে সরকার অথবা রাজনৈতিক নেতৃত্বে যদি কার্যকর সদিচ্ছা থাকে, তাহলে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ শুধু স্বপ্ন নয়, অবশ্যই সম্ভব। সরকার প্রতিবার বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিচ্ছে, আবার অন্যদিকে বলছে দুর্নীতি নির্মূল করতে আগ্রহী। এটা আত্মঘাতী স্ববিরোধিতা। একদিকে বলছে তুমি চুরি কোরো না, অন্যদিকে বলছে চুরি করলে পুরস্কৃত করা হবে—এই নীতি বদলাতে হবে। অন্যায় করলেই শাস্তি পেতে হবে, সে যে-ই হোক না কেন। দুর্নীতি যে শাস্তিযোগ্য অপরাধ, কোনো প্রকার ভয় বা করুণার ঊর্ধ্বে থেকে এটা প্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপার নয়।
 
কালের কণ্ঠ : আমাদের সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ
ইফতেখারুজ্জামান : কালের কণ্ঠকেও অনেক ধন্যবাদ।
 
 
ইফতেখারুজ্জামান: নির্বাহী পরিচালক, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)
সাক্ষাৎকারটি ০৮-০২-১৬ তারিখে দৈনিক কালের কন্ঠে প্রকাশিত। লিঙ্ক