প্রকাশকাল: ১২ অক্টোবর ২০১৫
ড. ইফতেখারুজ্জামান ২০০৪ সাল থেকে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশলান বাংলাদেশ (টিআইবি)’র নির্বাহী পরিচালক হিসেবে দায়িত্বরত রয়েছেন। টিআইবিতে যোগদানের আগে ড. ইফতেখারুজ্জামান বাংলাদেশ ফ্রিডম ফাউন্ডেশনের নির্বাহী, গবেষণা সংস্থা রিজিওনাল সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক এর নির্বাহী এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশলান অ্যান্ড স্ট্যাটেজিক স্টাডি এর রিসার্চ ফেলো ও রিসার্চ ডিরেক্টরের দায়িত্ব পালন করেন। ছোটবেলা থেকে প্রচন্ড মেধাবী ছিলেন ইফতেখারুজ্জামান। ১৯৬৮ সালে এইচএসসিতে যশোর বোর্ড থেকে ডিস্টিংশনসহ প্রথম স্থান লাভ করেন। এরপর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরপর রকলো ও ওয়ারশো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি বিভাগে উচ্চ শিক্ষা লাভ করেন। টোকিও ইউনিভার্সিটিতে ইফতেখারুজ্জামান রিলেশন বিভাগের পোস্ট ডক্টরাল ফেলো ছিলেন। প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশলানালের আন্তর্জাতিক পরিচালনা বোর্ডে সদস্য নির্বাচিত হন ড. ইফতেখারুজ্জামান। বর্তমানে তিনি এসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ফ্রিডম ফাউন্ডেশন, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য এবং আন্তর্জাতিক পার্বত্য কমিশনের সদস্য।
সমসমসাময়িক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ড. ইফতেখারুজ্জামান বাংলার কাগজকে একটি বিশেষ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন বাংলার কাগজ এর স্টাফ রিপোর্টার সানী ইসলাম।
বাংলার কাগজ :কেমন আছেন স্যার?
ইফতেখারুজ্জামান :ভালো আছি।
বাংলার কাগজ :টিআইবিতে আসার গল্পটা যদি বলতেন?
ইফতেখারুজ্জামান :টিআইবিতে আসার আগে আমি ভালোই ছিলাম, এখনো ভালোই আছি। টিআইবিতে আসার আগে বাংলাদেশ ফ্রিডম ফাউন্ডেশন নির্বাহী পরিচালক ছিলাম। তখন মোটামুটি শান্তিপূর্ণ জীবন-যাপন করছিলাম। আমি অন্য কোথাও যাবো, সেরকম চিন্তা-ভাবনা ছিল না। হঠাৎ একদিন আমার বোর্ডের মহাসচিব আমাকে বললো, সামনের দিকে তাকাবে কি না? আমি বললাম কেন, কি ব্যাপার? তিনি বললেন, টিআইবি তোমাকে চাচ্ছে। তারপর বললাম, আমি তো টিআইবি সম্পর্কে তেমন জানি না। তিনি বললেন, ব্যাপার না। তুমি কাজ করলেই সব জেনে যাবে। এভাবেই চলে আসলাম টিআইবিতে।
বাংলার কাগজ :বর্তমান সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনগুলো দেশে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটিয়ে যাচ্ছে। তাই বর্তমান বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতি থাকাটা কতটুকু যৌক্তিক? বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করে দেওয়া উচিত কিনা?
ইফতেখারুজ্জামান :ছাত্র রাজনীতি কলুষিত হয়েছে তার মানে দোষটা কিন্তু ছাত্র রাজনীতির না। বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতির ইতিহাস অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং ইতিবাচক ভূমিকা ছিল। মাথাব্যথা হলে মাথা কেটে ফেলতে হয় না। ছাত্র রাজনীতিকে কলুষিত করা হয়েছে উদ্দেশ্যমূলক ভাবে। জাতীয় রাজনীতির একাংশ যেমন অনিয়ম-দুর্নীতি এবং দখলাবাজিতে জড়িত, ঠিক তেমনি ছাত্র রাজনীতির একাংশ অনিয়ম-দুর্নীতি এবং দখলাবাজিতে জড়িয়ে পড়েছে। তার মানে এই নয় যে, এটা ছাত্র রাজনীতির দোষ। আমি ছাত্র রাজনীতির পক্ষে। ছাত্র রাজনীতিতে কিছু সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। সুষ্ঠু বিকাশের মাধ্যমে ছাত্র রাজনীতি থেকেই জাতীয় নেতৃত্ব গড়ে তোলার একটি বড় সুযোগ রয়েছে। তুমি চিন্তা করে দেখো, গত ২০ বছরের বেশি সময় ধরে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচন হয় না, ডাকসুর নির্বাচন হয় না। বর্তমান সময়ে যারা সুষ্ঠু রাজনীতির ধারক বাহক তাদের মধ্যে অনেকেই কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক রাজনীতির মাধ্যমে তাদের রাজনৈতিক হাতেখড়ি হয়েছে। আর ওই সুযোগটা কিন্তু বিনষ্ট করা হয়েছে এক ধরণের চক্রান্তের মাধ্যমে। সব চক্রান্ত কাটিয়ে উঠে ছাত্র রাজনীতিতে সুষ্ঠু ধারা বিকাশ করতে হবে।
বাংলার কাগজ :সম্প্রতি টিআইবি প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিভিন্ন কারণ ও তার প্রতিরোধের ৭টি সুপারিশ করা হয়। সেই সুপারিশের মধ্যে অন্যতম ‘পরীক্ষা মূলক প্রশ্নপত্র তৈরি, ছাপানো ও বিতরণ ডিজিটাল পদ্ধতিতে করা।’ এখানে ডিজিটাল পদ্ধতি বলতে কি বোঝানো হয়েছে?
ইফতেখারুজ্জামান :এখন তো ইন্টারনেটের যুগ। বাংলাদেশের সকল ইউনিয়নেই কিন্তু বর্তমানে ডিজিটাল সেন্টার রয়েছে। তাই এখন যেটা করা সম্ভব তা হলো, প্রশ্নগুলো অনলাইনে থাকবে। পরীক্ষা আরম্ভ হওয়ার আগ মুহূর্তে প্রশ্নপত্রগুলো একই সময়ে সকল পরীক্ষা সেন্টারে পৌঁছানো হবে। এই পদ্ধতিটি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই অনুসরণ করা হয়। এই পদ্ধতিটি পরীক্ষামূলক ভাবে বাংলাদেশে যাচাই করা উচিত এবং এই পদ্ধতিতে অনেকাংশেই প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধ হবে বলে আমরা মনে করি। আমরা অনুসন্ধানে দেখেছি, চলমান প্রশ্নপত্র তৈরির দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় যারা কাজ করছেন তাদের মধ্যে অনেককেই আমরা প্রশ্নপত্র ফাঁসের সাথে সম্পৃক্ত থাকতে দেখেছি। এই প্রশ্নপত্র ফাঁসে বড় ভূমিকা পালন করে থাকে কোচিং সেন্টারগুলো। যারা প্রশ্নপত্র সম্বলিত বই প্রকাশ করে তারা। তাদের একটা সিন্ডিকেট রয়েছে। এই সিন্ডিকেটটি ভাঙ্গতে হবে। এটা আমাদের মূল সুপারিশ ছিল।
বাংলার কাগজ :সম্প্রতি টিআইবি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এর সাথে কাজ করার অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়েছে। এর ফলে টিআইবি তার বিভিন্ন কর্মকান্ডে প্রশ্নবিদ্ধ হবে কি?
ইফতেখারুজ্জামান :এই বিষয় নিয়ে আলোচনা সমালোচনা হচ্ছে। এটা একটা ভালো দিক। টিআইবি যেন প্রশ্ন বিদ্ধ না হয় সে দিকে টিআইবি সবসময় সতর্ক থাকবে। দুদকের দূর্বল দিক। বিভিন্ন ভুল করলে তার সমালোচনা যেমন আমার আগে করেছি, বর্তমানেও তা অব্যহত আছে এবং থাকবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, কিছুদিন আগে দুদকের পক্ষ থেকে বেসিক ব্যাংকের ৫৪ জনের বিরুদ্ধে যে মামলা করা হয়েছে, সেখানে কিন্তু বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যানকে কোন জবাবদিহীতার মধ্যে আনা হয়নি। এই বিষয়ে টিআইবি কিন্তু কড়া সমালোচনা করেছে। অর্থাৎ আমাদের যে মূল দায়িত্ব সেখান থেকে সড়ে না এসে, দুদক যেন আরো কার্যকর হয় সেই লক্ষ্যে দুদকের প্রচারমূলক কর্মকান্ডগুলোর সাথে আমরা কাজ করবো। কারণ আমাদের কাজও প্রচারণামূলক। তবে আমরা ঠিক করবো কোন কাজটি দুদকের সাথে করবো, আর কোনটি করবো না।
বাংলার কাগজ :১৯৯৬ সালে বাংলাদেশে টিআইবি প্রতিষ্ঠার হওয়ার পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত টিআইবি তার লক্ষ্যে কতটুকু সফল হতে পেরেছে বলে আপনি মনে করেন?
ইফতেখারুজ্জামান :কেউ যদি মনে করে আমাদের লক্ষ্য বাংলাদেশে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা, তাহলে আমরা সেই লক্ষ্যে পৌঁছতে পারিনি। আমাদের লক্ষ্য দুর্নীতির বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধি করা, দুর্নীতিবিষয়ক গবেষণা ও প্রকাশ করা। আমাদের গবেষণার তথ্যের উপর নির্ভর করে চাহিদা সৃষ্টি করা। যাতে করে দেশের আইনে দুর্নীতিবিরোধী শক্তিশালী ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। আমরা মনে করি, সেই কাজগুলো আমরা সফল ভাবে করতে পেরেছি। আমাদের কাজের ফলে অনেক ইতিবাচন আইন, গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি হয়েছে হয়েছে।
তবে আমাদের অনেক দূর যেতে হবে। আমরা যে চাহিদাটা সৃষ্টি করতে পেরেছি সেটা যদি পুরোপুরি কার্যকর হয়। সরকার এবং অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের যে নির্ধারিত দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে সেগুলো যথাযথ ভাবে পালন করে। তাহলে আমাদের যে চূড়ান্ত লক্ষ্য রয়েছে তা সফল হবে বলে আমি মনে করি।
বাংলার কাগজ :বর্তমান ইফতেখারুজ্জামান আর তরুণ ইফতেখারুজ্জামানের মাঝে কি মিল রয়েছে এবং কোন তরুণ যদি ইফতেখারুজ্জামান হতে চায় তাহলে তাকে কি পরামর্শ দিবেন?
ইফতেখারুজ্জামান :আমি এখনো তরুণ। যেসব তরুণরা ইফতেখারুজ্জামান হতে চায় তাদের জন্য আমার পরামর্শ হচ্ছে- সৎ হতে হবে। লক্ষ্য স্থির করতে হবে। আর সেই লক্ষ্যকে মাথায় রেখে সততা সাথে নিজের যে সামর্থ, মেধা যোগ্যতা রয়েছে সেটার পরিপূর্ণভাবে প্রয়োগ করতে হবে। কোন ভাবেই সততা থেকে বিচ্যুত হওয়া যাবে না। সতাতা থেকে বিচ্যুত হয়ে সাময়িকভাবে লাভবান হওয়া যায়, কিন্তু চূড়ান্ত বিজয়ের জন্য সততাই হচ্ছে অন্যতম বাহন।
বাংলার কাগজ :টিআইবি তরুণদের নিয়ে কাজ করে। তো আপনি তরুণদের নিয়ে কতটুকু আশাবাদী? তরুণদের নিয়ে কখনো হতাশ হয়েছেন কি?
ইফতেখারুজ্জামান:আমি তরুণদের নিয়ে খুবই আশাবাদী। হতাশ হয়েছি এটা বলা ঠিক হবে না। তবে মাঝে মাঝে প্রশ্ন জেগেছে, আমারা কি তরুণদের জন্য সঠিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে পেরেছি? কিন্তু মাঝে মাঝে আবার আমি এই প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাই, যখন দেখি তরুণরা গণজাগণ মঞ্চের মতো গণআন্দোলন তৈরি করে, প্রাইবেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যখন সম্পূর্ণ রাজনীতি বিমুখ আন্দোলন তৈরি তাদের দাবি আদায়ে সফল হয়। তখন আমি সত্যিই উৎসাহিত হই। আবার যখন এই গণজাগরণ মঞ্চকে রাজনৈতিক প্রভাবে প্রভাবিত করে ব্যবহার করা হয় এবং এদের যে লক্ষ্য রয়েছে তা লক্ষ্যভ্রষ্ট্র করা হয় তখন আমি সত্যি আশাহত হই। তবে একটা কথা মনে রাখতে হবে, সমস্যা কিন্তু তরুণদের মাঝে নয়, যারা রাষ্ট্রপরিচালনা করে তারা তাদের নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য তরুণদের একাংশ ব্যবহার করে তখনই কিন্তু তরুণরা কুলষিত হয়। এর দায় আমি তরুণদের যতটুকু দিব তার চেয়ে আমি বেশি দিব যারা তরুণদের অসৎ পথে ব্যবহার করে।
বাংলার কাগজ :স্যার আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
ইফতেখারুজ্জামান :ধন্যবাদ।
ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক,ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি)।
সাক্ষাৎকারটি ১২/১০/১৫ তারিখে বাংলার কাগজ পত্রিকায় প্রকাশিত। লিঙ্ক