সংকটের শেষ কোথায়?

প্রকাশকাল: ২০ ডিসেম্বর ২০১৩

 
আগামী ৫ জানুয়ারি নির্ধারিত নির্বাচন-কেন্দ্রিক ঘটনাপ্রবাহে এতটুকু পরিষ্কার যে, যদি একতরফাভাবে এ নির্বাচন প্রক্রিয়া শেষ করা হয়, বিশেষ করে তা যদি পরিপূর্ণ অংশগ্রহণমূলক না হয়, তবে তার গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। ভোটের অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক অধিকার। এ অধিকার তখনই যথার্থ হয় যখন ভোটারদের সামনে সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্য থেকে বাছাই করে কারও পক্ষে ভোট দেওয়ার সুযোগ থাকে। নির্বাচনে সব আগ্রহী নিবন্ধিত দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা না হলে এবং সব অংশগ্রহণকারীর জন্য সমান প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র নিশ্চিত করা সম্ভব না হলে ভোটারদের ভোটাধিকার প্রয়োগ যথার্থ হবে না, এটাই স্বাভাবিক। সেই অর্থে একতরফা নির্বাচন জনগণের ভোটের অধিকারের অবমূল্যায়নের শামিল। অন্যদিকে বিরোধী দল কর্তৃক নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে যদি ৫ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সরকার পক্ষ অনড় থাকে তাহলে চলমান সহিংসতা ও সংঘাত আরও ব্যাপকতর রূপ ধারণ করতে পারে। যা গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ ও দেশবাসীর স্বার্থের বিচারে অত্যন্ত আশঙ্কাজনক। তবুও আমি আশাবাদী। অভিন্ন লক্ষ্যের জন্য না হোক, অভিন্ন ঝুঁকির বিবেচনায় বিবদমান দুই পক্ষ- প্রধান দুটি দলের শীর্ষ দুই নেত্রী ঐকমত্যে পৌঁছানোর জন্য আগ্রহী হতে পারেন। আর এই ঝুঁকি হলো গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা ব্যাহত হওয়ার ঝুঁকি, মানুষের কল্যাণ ও দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির সম্ভাবনা ভূলুণ্ঠিত হওয়ার ঝুঁকি। দেশের আপামর জনগণের জন্য সেটি যেমন উদ্বেগজনক তার চেয়ে বেশি উদ্বেগজনক দুই নেত্রীর জন্য। কারণ তারাই বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার সর্ববৃহৎ পতাকাবাহী। দেশের ১৬ কোটি মানুষের তুলনায় তাদের আরও বেশি উদ্বিগ্ন হওয়ার কথা। দেশবাসী যেমন সে পরিণতি দেখতে চায় না, আমার দৃঢ় বিশ্বাস তারাও সেটি প্রতিহত করতে চান। তাই আমি আশাবাদী, বিপরীতমুখী অনড় অবস্থান থেকে সরে এসে তারা ছাড় দেওয়ার মানসিকতা নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে গ্রহণযোগ্য সমাধান খুঁজে বের করবেন। তবে দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, এই মুহূর্তে তার কোনো ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে না। যদি বিপরীতমুখী অবস্থানের পরিবর্তন না হয় তাহলে কী ঘটতে পারে তা নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করা কঠিন। তবে এটুকু বলতে পারি, গণতন্ত্র ও জনগণের স্বার্থ ধূলিস্যাৎ হবে। ক্ষমতার রাজনীতির বলির পাঁঠা হবে দেশের জনগণ। স্বাধীনতার ৪২ বছরে একটি বিষয়ে বর্তমানের মতো এত উদ্বিগ্ন আগে কখনো ছিলাম না। তা হলো আমাদের দুই বৃহৎ দলের বিপরীতমুখী ও সংঘাতময় অবস্থানের কারণে অগণতান্ত্রিক শক্তির ব্যাপক সন্ত্রাসী ও সহিংস উত্থান। যা উভয় পক্ষের জন্যই আত্দঘাতী। ভয়ঙ্করভাবে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, এ দেশের মানুষের মৌলিক মূল্যবোধ, গণতান্ত্রিক চর্চা, সমঅধিকার ও আইনের শাসন। আমার শঙ্কা, অগণতান্ত্রিক শক্তির এই নগ্ন সহিংসতা যদি এখনই প্রতিহত করা না যায়, তাহলে অচিরেই হয়তো বা তা আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে যেতে পারে। আর আমার দৃষ্টিতে এই অপশক্তিকে প্রতিহত ও পরাভূত করার চাবিকাঠি রয়েছে বৃহৎ দুটি দলের শীর্ষ নেতৃত্বেরই হাতে। মূলধারার রাজনীতিতে যত বেশি গণতান্ত্রিক সমঝোতা ও ইতিবাচক রাজনীতির বিকাশ ঘটবে তত সহজেই অগণতান্ত্রিক শক্তির পরাজয় নিশ্চিত হবে। মৌলবাদসহ সব উগ্র ও অগণতান্ত্রিক শক্তির উত্থানের প্রতিরোধ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই সম্ভব বলে আমি মনে করি। দুই নেত্রীই তা পারেন সমঝোতা ও ঐকমত্যের মাধ্যমে। তা না হলে ব্যর্থতার দায় তাদেরই নিতে হবে, যেমন তারা পাবেন সাফল্যের জন্য জনগণের প্রশংসা। 
 
ইফতেখারুজ্জামাননির্বাহী পরিচালকট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)
 
লিখাটি ২০-১২-১৩ তারিখে বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় প্রকাশিত।
লিঙ্ক