বিচারহীনতার সংস্কৃতি বিরাজ করায় দুর্নীতি বাড়ছে

প্রকাশকাল: ১৭ জুন ২০১৪

 
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবিনির্বাহী পরিচালক ডইফতেখারুজ্জামান। বাংলাদেশে টিআইবির কার্যক্রমতাদের গবেষণা পদ্ধতিপ্রাতিষ্ঠানিক স্বচ্ছতা ও সম্প্রতি দুদকের সঙ্গে ঘটে যাওয়া বিতর্কসহ বিবিধ বিষয়ে আলোকিত বাংলাদেশের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেনকাজল রশীদ শাহীন
 
আলোকিত বাংলাদেশ দুদকের সঙ্গে হঠাৎ করে একটা বিষয়ে আপনারা মুখোমুখি অবস্থায় গিয়েছিলেনতার পরবর্তী ফলোআপ?
ইফতেখারুজ্জামান আমরা তো মনে করিআমরা দুদকের সহায়ক শক্তি। বাংলাদেশে দুদকের সৃষ্টিএর বিবর্তনআইনি কাঠামোমূল আইনের খসড়া প্রণয়নসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে টিআইবি চেয়েছে দুদক একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠুক। আমরা এখনও সেই অবস্থায় আছি। আমরা মনে করিদুদকেরও একই অবস্থা। যেটা হয়েছেতা একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। আজকেও দুদকের সঙ্গে আমাদের একটি বৈঠক ছিল। দুদক ও টিআইবি মুখোমুখি হোক সেটা আমরা কখনও চাই না এবং আমার ধারণাতারাও চান না। কিছু ভুল বোঝাবুঝি হতেই পারেতারই কিছু প্রতিফলন ঘটেছে। তবে আমার জানামতেদুদক আর তার ওই অবস্থানে নেই।
 
দুদকের ঘটনার পর আপনারা কি কোনো রকম হুমকি বোধ করছিলেন?
** মোটেই নয়। আমরা কোনো হুমকি বোধ করিনি। বরং যে কথাটি আমরা জোর দিয়ে বলেছি তা হলোযে কোনো ব্যক্তিপ্রতিষ্ঠান যদি আমাদের স্বচ্ছতা ও সততা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেসবাইকে আমরা সহযোগিতা করব। যেভাবে আমরা দুদককে চ্যালেঞ্জ করে বলেছিলাম তারা চাইলে আমরা সহযোগিতা করতে রাজি আছি। তাই আমরা কোনো রকম হুমকি বোধ করিনি। আমরা যেমন অন্যসব প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতার জবাব দিতে চাইসরকারি প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতার জবাব দিতে চাইবেসরকারি প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতার জবাব দিতে চাইদুদকের স্বচ্ছতার জবাব দিতে চাইতেমনি আমরা মনে করিআমাদের স্বচ্ছতার জবাবদিহি করা প্রয়োজন। কারণ আমরা যদি নিজেদের স্বচ্ছতার জবাবদিহি না করি তাহলে তো আমাদের নৈতিক অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়বে। তাই আমাদের প্রচেষ্টা থাকে সব সময় স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠার জন্য। যে কেউ আমাদের স্বচ্ছতা নিয়ে চ্যালেঞ্জ করতে চাইলে তাদের সর্বদা স্বাগত জানাই। এবার দুদককে স্বাগত জানিয়েছিভবিষ্যতেও তা করব।
 
যখন দুদকের সঙ্গে আপনাদের দ্বন্দ্ব চলছিল তখন গণমাধ্যম ও ফেসবুকে আপনাদের নিয়ে কিছু জিজ্ঞাসা তৈরি হয়েছিল। সেই জিজ্ঞাসার উত্তরগুলো কি আপনারা দিতে পেরেছেন?
** গণমাধ্যম একটি বিশাল ব্যাপারএটা একটি ওপেন স্পেস। এখানে অনেক মানুষ অসংখ্য মতামত দিতে পারে। তবে আমাদের জানামতেঅনলাইন মতামত ও সার্বিকভাবে যে প্রতিক্রিয়া এসেছে এবং গণমাধ্যমে এখন পর্যন্ত যে প্রতিক্রিয়া দেখতে পাই সেটা আমাদের অবস্থানের জন্য সহায়ক।
 
কিন্তু জনমনে এ নিয়ে তখন প্রশ্ন উঠেছিলএ উত্তরটা কী আপনারা আগেই দিয়ে দিতে পারতেন নাকিংবা আপনাদের অবস্থান আরও স্বচ্ছতার সঙ্গে প্রকাশ করতে পারতেন না।
** এ কথাগুলো আমরা সব সময় বলে আসছি। আমাদের সবকিছুই খোলা আছে। আমরা কোন খাত থেকে টাকা পাইকোন খাতে ব্যয় করিতা সব সময় জনসম্মুখে প্রকাশ করে আসছি। কিছু কিছু ব্যক্তি হয়তো থাকতে পারেনকোন কোন মহলেযারা এ বিষয়টি নিয়ে এক ধরনের আনন্দ পান বা এ ধরনের প্রশ্নগুলো উত্থাপন খুব সহজ মনে করেন। এ নিয়ে আমি আপনাদের একটি দৃষ্টান্ত দিই।
 
জিবলুন?
** কোনো এক সময় সরকারের অত্যন্ত প্রভাবশালী এক মন্ত্রী গণমাধ্যমে আমাদের সম্পর্কে একাধিকবার বলেছিলেনটিআইবি দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলেস্বচ্ছতার কথা বলে অথচ টিআইবি দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ড কম ও এনরলএদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ ও সহায়তা গ্রহণ করে। তিনি এ কথাটি যখন গণমাধ্যমে একাধিকবার বললেন তখন তাকে আমরা লিখিতভাবে চিঠি দিলাম। বললামমাননীয় মন্ত্রী আপনি এ কথাটি বলেছেন কিন্তু সরকারের মন্ত্রী হওয়ার সুবাদে আপনার তো জানার কথা টিআইবি কোন সূত্র থেকে অর্থ সংগ্রহ করে। সরকারের অনুমতি ছাড়া আমরা একটি টাকাও গ্রহণ করি না। গ্রহণ করতে পারি না। সরকারের অনুমতি ছাড়া একটি টাকা ব্যয়ও করতে পারি না। আবার সরকারকে আমাদের জবাবদিহি করতে হয়। মন্ত্রী হিসেবে সেটা আপনার জানা কথা এবং আমরা এটাও বলে দিয়েছিআমরা কত টাকা পাব তা আমরা জানার আগে সরকার জেনে যায়। বাজেটের জন্য আমরা সরকারকে প্রস্তাবনা দিইসরকার সেটা অনুমোদন করলেই আমরা অর্থ পাই। কাজেই সরকারের একজন মন্ত্রী হিসেবে উনার কিন্তু সবার আগে জানার কথা। এসব জানানোর পর বলেছিলামএই হলো আমাদের অর্থসূত্র এবং ভবিষ্যতে আমাদের সম্পর্কে মন্তব্য করতে গেলে এগুলো একটু মনে রাখবেন। তবে মন্ত্রী সাহেবরা সাধারণত যা করেন নাতিনি দুই লাইনের একটি চিঠি আমাদের পাঠিয়েছিলেন। বলেছিলেনইফতেখারুজ্জামান সাহেবআপনার চিঠির জন্য ধন্যবাদআপনাদের দেয়া এ তথ্যগুলো আমার কাজে লাগবে। আমি তো খুশি হলামভাবলামকাজে লাগবে। কিন্তু এর দু'দিন পর এক লাইভ প্রোগ্রামে ওই একই মন্ত্রী বললেনটিআইবি ওয়ার্ল্ডকমএনরল থেকে অর্থসংগ্রহ করে। তাই আমি বলবআপনি ঘুমন্ত শিশুকে জাগ্রত করতে পারেনকিন্তু যে ঘুমের ভান করে থাকে তাকে তো জাগ্রত করতে পারেন না।
 
টিআইবি তো এনজিও ব্যুরোর সদস্য?
** হ্যাঁআমরা এনজিও ব্যুরোর নিবন্ধনপ্রাপ্ত একটি প্রতিষ্ঠান। টিআইবি একটি এনজিও। আমরা একটি ট্রাস্ট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। যেহেতু বিদেশি অর্থায়নে আমরা চালিত তাই এনজিও হিসেবে নিবন্ধিত রয়েছি।
 
এনজিওদের নিয়ে একটি নতুন আইনের খসড়া তৈরি হয়েছেএ ব্যাপারে আপনার মতামত কী?
** এখানে আমি বলব একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া আছে। আমরা তো বেসরকারি খাত নিয়ে গবেষণা করি। এনজিও খাত নিয়েও আমরা গবেষণা করেছি। এ নিয়ে ২০০৮ সালে আমাদের একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। যেখানে এনজিও খাতের চ্যালেঞ্জ নিয়ে আমরা কাজ করেছিলাম। আমাদের একটি অবস্থান আছেআমরা সব ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা দেখতে চাই। সে পরিপ্রক্ষিতে এনজিও ব্যুরোও আমাদের সহায়তা নিয়েছে। আমরা তাদের কৌশলগত সমর্থন জুগিয়েছি। তবে এই যে আইনটির কথা বলা হচ্ছে সেটির খসড়া তৈরি হয় ২০১০ সালে। আমাদের কাছে যখন খসড়াটি পাঠানো হলোকেবল টিআইবি নয় আরও অনেক প্রতিষ্ঠানের কাছে পাঠানো হয়েছিলখসড়াটি দেখে আমরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলাম। এর মধ্যে বেশ কিছু ঝুঁকিপূর্ণ ক্ষেত্র ছিল। সেগুলো নিয়ে আমরা সরকারের সঙ্গে এক ধরনের অঙ্গীকারে পৌঁছুতে পেরেছি। তাদের সঙ্গে বেশ কয়েক দফা আমরা বৈঠক করি। তখন ঠিক হয়েছিল আমরা যেসব পরামর্শ দিয়েছি সেগুলো বিবেচনা করে চূড়ান্ত আইন তৈরি করে আবার আমাদের সঙ্গে আলোচনা করা হবে। কিন্তু চূড়ান্ত খসড়াটি সরকার আর আমাদের দেখাতে পারেনি। না দেখিয়ে খসড়াটি অনুমোদন করিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদে। আমি এখানে একটি বিষয় জোর দিয়ে বলতে চাইআমি এ অভিজ্ঞতাকে অত্যন্ত ইতিবাচক হিসেবে বিবেচনা করি। যে খাতের জন্য আইন সরকার সে খাতের স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে ব্যাপক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে একটি ইতিবাচক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। ফলে জটিল ও নেতিবাচক আইন থেকে বিষয়টি ইতিবাচক আইনে চলে এসেছে। কিন্তু ঘাটতি হলো আইন প্রাথমিক পর্যন্ত থেকে চূড়ান্ত করার পর্যায়ে আমাদের সঙ্গে আলোচনার যে অঙ্গীকার করেছিলেন সেটা তারা করেননি। মন্ত্রিপরিষদে অনুমোদন করিয়েছেন। যার ফলে এ খসড়াটি যখন প্রকাশিত হলোগণমাধ্যমে এলোআমরা দেখলাম বিভিন্ন পর্যায়ে আমাদের যেসব প্রস্তাব ছিল সার্বিকভাবে প্রায় সবক'টির প্রতিফলন ঘটেছে। তবে এখনও বেশ কিছু ঝুঁকির জায়গা রয়েছে। সেগুলো নিয়ে এখনও সরকারের সঙ্গে আমাদের আলোচনার সুযোগ আছে। সরকার সে আলোচনার সুযোগ আমাদের দেবেন। যাতে করে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি আইন হয়। বাংলাদেশের এনজিওগুলো স্বাধীনতার সময়কাল থেকে দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। আর্থসামাজিক উন্নয়নসেবাবিভিন্ন বিষয়ে আইন প্রণয়নের দাবির পাশাপাশি মানবাধিকারসুশাসনদুর্নীতি রোধ প্রভৃতি খাতে বেসরকারি সংস্থাগুলো ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। এটার স্বীকৃতি সরকারও দেয়। আর দেয় বলেই সরকারের সঙ্গে আমাদের অঙ্গীকার তৈরি হয়েছে। এ পর্যায়টি অব্যাহত রাখার জন্য সরকার যদি আমাদের সুযোগ দেয় তবে ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে আমরা আরেকবার আলোচনা করতে চাই। তবে একটি বিষয়এ আইনটি কেবল টিআইবিকে কেন্দ্র করে নয়এটা সার্বিকভাবে বেসরকারি খাতএনজিওর জন্য। আমরা আইনের ঝুঁকিপূর্ণ দিকগুলো চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছিআশা করি সরকার বিবেচনা করবে।
 
আপনি কি বাংলাদেশের টিআই-এর সঙ্গে প্রথম থেকেই জড়িত ছিলেন?
** বাংলাদেশে টিআইবির কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৯৬ সাল থেকে। আমি টিআইবিতে আছি ২০০৪ সাল থেকে।
 
বাংলাদেশ পরপর কয়েকবার দুর্নীতির শীর্ষ দেশ হিসেবে পরিচিতি পায়। এরপর এগিয়ে যাওয়া। আপনি কি মনে করেন দুর্নীতি রোধে দেশে টিআইবির কোনো ভূমিকা রয়েছে?
** আমরা কতটুকু করতে পেরেছি সেটা অন্যরা মূল্যায়ন করতে পারবে। আমরা মনে করিটিআইবি থেকে আমরা যে কাজটি করতে পেরেছিসেটা হলো দুর্নীতি বাংলাদেশে ব্যাপক একটি সমস্যাসেই সমস্যাটিকে চিহ্নিত করে কোন প্রতিষ্ঠানে কীভাবে হয়কোন ধরনের অনিয়মগুলো হয়তা নিয়ে জনগণের মধ্যে আমরা সচেতনতা সৃষ্টি করতে পেরেছি। কেবল তাই নয়সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিক দলের মধ্যে দুর্নীতি বিষয়ে সচেতনতা এবং চাহিদা তৈরি করতে পেরেছি। সেজন্য রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী মেন্যুফেস্টোতে দুর্নীতিবিরোধী কর্মসূচি থাকে। এটা একটি দিক। আরেকটি দিক হলো বর্তমান সরকারসহ আগের সরকারের সঙ্গে আমরা বিভিন্ন আইনি সংস্কার ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার নিয়ে কাজ করেছি। আজকে যে জাতিসংঘের দুর্নীতিবিরোধী কনভেনশনের স্বাক্ষরকারী যে বাংলাদেশ এর পেছনেও টিআইবির প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল। এ ধরনের বিষয়ে সরকারের সঙ্গে কাজ করে আমরা চেষ্টা করছি বাংলাদেশে দুর্নীতি প্রতিরোধের জন্য যেন শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক ও আইনি কাঠামো সৃষ্টি হয়। এর একটি ইতিবাচক অবস্থান বিশ্ব দুর্নীতি সূচকে অবশ্য থাকতে পারে। আবার এ সূচকে যা বলা হয় একটি দেশ আগের থেকে ভালো করলতা এমনও হতে পারে হয় ভালো করেছে কিংবা অন্য দেশগুলো আমাদের চেয়ে খারাপ করেছে। তাই এ থেকে আন্তর্জাতিক অবস্থাটি চূড়ান্তভাবে বলা যাবে না। আমাদের মনে হয় দুর্নীতি প্রতিরোধে আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি ক্রমাগত শক্তিশালী হচ্ছেকিন্তু প্রয়োগের ক্ষেত্রে ঘাটতি রয়েছে। আমাদের প্রতিষ্ঠান আছেআইন আছেনিয়ম আছেবিধিমালা আছে অনেকটা কম্পিউটারের হার্ডওয়্যারের মতোকিন্তু চর্চাটি নেইমানে সফটওয়্যার নেই। ফলে কম্পিউটার অনেক সময় চলে না। এর ফলে দুর্নীতি যারা করে তারা পার পেয়ে যায়। এক ধরনের বিচারহীনতার সংস্কৃতি বিরাজ করে। যে কারণে দুর্নীতি ব্যাপকভাবে বাড়তে থাকে। আমরা দুর্নীতিবিরোধী চাহিদা সৃষ্টির মাধ্যমে একটি কাঠামো সুদৃঢ় করার চেষ্টা করেছি।
 
টিআই তো অন্যান্য দেশেও আছে। সেখানেও কি সরকার ও সুবিধাবাদী গোষ্ঠী বাংলাদেশের মতো এর বিরুদ্ধে সমালোচনামুখর হয়ে ওঠে।
** বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোতে মোটামুটি একই ধরনের চিত্র। সমালোচনা সইবার সৎসাহস ও মানসিকতার ঘাটতি উন্নয়নশীল দেশগুলোতে রয়েছে। তবে বাংলাদেশে অবশ্য আমরা খুব অ্যাকটিভ চ্যাপ্টার। ১০০টি দেশের টিআই চ্যাপ্টারের তুলনায় বাংলাদেশ চাপ্টার বড় ও সক্রিয় চ্যাপ্টার। আমরা ব্যাপক পরিসরে কাজ করছি। সে কারণে গণমাধ্যমে আমাদের প্রচারণা ও মানুষের কাছে আমাদের গ্রহণযোগ্যতা তুলনামূলকভাবে বিস্তৃত। সে কারণে সরকার থেকে আমাদের কর্মকান্ডের প্রতিক্রিয়া অধিকএর মানে আমাদের কাজের গুরুত্ব এখানে অধিক অনুভূত হয়।
 
দেখা যায় মিডিয়াগুলোতে মাসে হলেও টিআইবির উপস্থিতি থাকেকিন্তু ভারতে পত্রপত্রিকায় টিআইয়ের উপস্থিতি দেখা যায় না। এমনকি বিবিসিতেও। এর মানে কি ওসব দেশে দুর্নীতি কমতাই?
** নাওসব দেশে দুর্নীতি কম তা বলা যাবে না। কাজের যে সক্রিয়তা সেটার ওপর অনেকটা নির্ভর করে। আমাদের সৌভাগ্য যেবাংলাদেশের ব্যাপক সমস্যা আমরা তুলে ধরতে পেরেছি। এর ফলে গণমাধ্যম আমাদের কাজটিকে ইতিবাচক হিসেবে নেয়আমাদের প্রতিটি প্রতিবেদন প্রকাশ করার পর সব পত্রিকা ও টেলিভিশন আমাদের কভারেজ দিয়ে সহযোগিতা দিয়ে থাকে। আর সরকারের তরফ থেকে যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সে সম্পর্কে বলা যায়আমাদের দেশ থেকেও ঝুঁকিপূর্ণ দেশ রয়েছে।
 
কোনো দেশে কি টিআই-এর কাজ গুটিয়ে নেয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে?
** গুটিয়ে নেয়ার অভিজ্ঞতা হয়নি। তবে আমাদের মতো যারা কাজ করেছেযারা নেতৃস্থানীয় রয়েছেন তাদের বিভিন্নভাবে ঝুঁকির সম্মুখীন হতে হয়েছে। বিশেষ করে আফ্রিকার কোনো কোনো দেশে নিরাপত্তার ঝুঁকিতে পড়তে হয়েছে। এশিয়াতেও হয়েছে। সৌভাগ্যের বিষয়প্রতিক্রিয়াই আমরা দেখতে পাইবিশেষ করে সরকারের একাংশেরকোনো কোনো মহলের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়াও দেখা যায়। কৌতূহলের বিষয় হলোযারাই ক্ষমতায় আসেন তাদের একাংশ নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখানবিরোধী দলে গেলে আমাদের প্রতিক্রিয়াকে স্বাগত জানান। এর মাধ্যমে বোঝা যায়আমাদের কাজের বস্তুনিষ্ঠতাদলনিরপেক্ষতা এবং রাজনীতি প্রভাবের ঊর্ধ্বে এবং জনস্বার্থের প্রতিফলন।
 
টিআইবি ১৯৯৬ সাল থেকে বাংলাদেশে কাজ করছে। তখন থেকে গণতন্ত্রের যে ধারাসেটি ২০১৪ সালে এসে বাধাগ্রস্ত হলো। গণতন্ত্রের অন্তরায় হলো সুশাসন ও দুর্নীতিযা নিয়ে আপনারা কাজ করছেন। আজকের অবস্থায় কি আপনাদের কাজের প্রক্রিয়া পরিবর্তনের কোনো তাগিদ বোধ করছেন?
** আমরা সাধারণত যেসব কাজ করি সেগুলোর কোনো বড় রকমের পরিবর্তনের সুযোগ নেই। আমাদের কাজের মূল বিষয় হলো আমরা একটি জবাবদিহিমূলক সরকার চাই। আর যত বেশি গণতান্ত্রিক সরকার হবে তত বেশি জবাবদিহিমূলক সরকার হবে। জবাবদিহিমূলক সরকার মানে উন্মুক্ততাস্বচ্ছতাজনগণের অংশগ্রহণযে জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠান আছে তাদের কার্যকলাপ। আপনারা লক্ষ্য করুনআমরা যেসব প্রতিষ্ঠান নিয়ে কাজ করি সবই কিন্তু জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আর আমরা এ ধারাটিই অব্যাহত রাখব। তবে দেখতে হবেআমাদের কর্মকান্ডের ফলে এ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে কোনো গুণগত পরিবর্তন ঘটেছে কিনা। আমাদের কথা হলোআমরা এ চাহিদা তুলে ধরবতথ্যমূলকভাবে। আমরা বলিআমরা জ্ঞানভিত্তিক অ্যাডভোকেসি প্রতিষ্ঠান। আমরা গবেষণা করে জ্ঞান সৃষ্টি করিসে জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে আমরা চাহিদা সৃষ্টি করিএ চাহিদাকে আমরা পলিসি চেঞ্জের মধ্যে রূপান্তরের চেষ্টা করি। এ পরিবর্তনটি যদি আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে জবাবদিহি কাঠামোকে শক্তিশালী করতে পারে তখনই আমাদের অর্জন হবে। এখানে নতুন কিছু নেইতাই আমাদের কার্যক্রম পরিবর্তনের দরকার নেই।
 
আপনি দুর্নীতির কথা বলেছিলেনএর পরিমাণ কিন্তু বেড়ে গেছেকিংবা সন্ত্রাসসব মিলিয়ে অন্ধকারের চিত্রটি যদি প্রতিতুলনা করা যায়...
** ঠিক অন্ধকার বলা যাবে না। আমরা কেবল হোঁচট খাই। আমরা সামনের দিকে যাইআবার পেছনের দিকে আসি। অনেকটা বানরের পিচ্ছিল বাঁশে ওঠার মতো। আমাদের ক্রমাগত ওঠানামা করতে হচ্ছে। সত্যিকার অর্থে এ অবস্থা পরিবর্তনে টিআইবির একক সামর্থ্য নেই। আমরা কেবল চাহিদা সৃষ্টি করতে পারি। এখানে কিন্তু আরও অনেকের ভূমিকা রয়েছে। এখানে সাধারণ মানুষ আছেপ্রতিষ্ঠানগুলো আছেরাজনৈতিক দলগুলো আছেসংসদ ও বিচার ব্যবস্থা আছেপ্রশাসন ও সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গসহ সবার ভূমিকা রয়েছে। এখানে কেবল টিআইবির ভূমিকার ফলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সুদৃঢ় হয়ে যাবেএ দায় কিন্তু বড় বেশি হয়ে যাবে। আমরা কেবল একটি সহায়ক শক্তিমাত্র।
 
আপনাদের গবেষণা পদ্ধতি নির্ভর করে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে নাকি আপনারা অনুসন্ধান করে কোনো কিছু বের করে তার ওপর গবেষণা করেন?
** আমরা দুটোই। সামাজিক বিজ্ঞান গবেষণার যে স্বীকৃত পদ্ধতিগুলো আছে সেগুলো আমরা ব্যবহার করি। কোনো গবেষণা আছে সংখ্যাগত তথ্যের ওপর নির্ভরশীলকোনো কোনো পদ্ধতি মানগত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুটিরই সংমিশ্রণ আমরা করে থাকি। আর আমাদের যেহেতু দুর্নীতিবিষয়ক কাজআমরা এমন উৎকৃষ্টতার সঙ্গে করিযাতে যে প্রতিবেদন আমরা তৈরি করি তাকে ডিফেন্ড করতে পারি। আর সেটা করতে পেরেছি বলেই আমাদের গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে।
 
কিছুদিন আগে আপনারা সংবাদপত্র নিয়ে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন। একজন সংবাদকর্মী হিসেবে তা নিয়ে আমার কিছু প্রশ্ন রয়েছে। আপনারা সংবাদপত্রের যে সঙ্কটের কথা বলেছেনসেখানে কি প্রকৃত চিত্রটি এসেছে?
** আমরা গণমাধ্যম নিয়ে যে গবেষণাপত্রটি উপস্থাপন করেছিএর বাইরে আরেকটি ব্যাপক গবেষণা চলমান রয়েছে। সেখানে আমরা আরও গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করব। এরপরও যে গবেষণাটির কথা আমরা বলেছি সেখানে সার্বিক চিত্রটি কিন্তু মূলত এ খাতের কয়েকটি বিষয় আমরা দেখছি। এ খাতের অবদানভূমিকাআইনি কাঠামোজবাবদিহিতাউন্মুক্ততা ও বস্তুনিষ্ঠতার বিষয়গুলো। অন্যদিকে এ খাতের ওপর বিভিন্ন রকম চ্যালেঞ্জগুলো। এর ওপর ভিত্তি করেই আমরা কিছু সুপারিশ করেছি। আমরা মনে করিসরকারসহ যারা এ বিষয়ে নেতৃত্বের পর্যায়ে রয়েছেনযারা এগুলো বিবেচনা করলে হয়তো গণমাধ্যমে আরও ভালো জায়গায় যেতে পারবে। আমরা মনে করিনানামুখী চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও আমাদের গণমাধ্যম অনেক ক্ষেত্রে উন্নত দেশের গণমাধ্যম থেকেও সক্রিয়।
 
আপনারা কি সরাসরি বাজেটকেন্দ্রিক কোনো গবেষণা করেছেন?
** না। তবে বাজেটের দু'একটি বিষয় নিয়ে আমরা সব সময় সোচ্চার। যেমনবাজেটে কালো টাকার যে সুযোগ রাখা হয় আমরা তার বিরুদ্ধে আহত সৈনিকের মতো সব সময় প্রতিবাদ করে আসছি। কারণএটা অসাংবিধানিকবৈষম্যমূলক ও অনৈতিক। আরেকটি বিষয়আমরা চাই বাজেট বিষয়ে আরও বেশি তথ্য সাধারণ মানুষের কাছে যাক। আমাদের বাজেট আন্তর্জাতিক উন্মুক্ত সূচকে মোটামুটি মাঝামাঝি অবস্থায় রয়েছে। এটাকে আরও ভালো করা যেতে পারে। আমাদের প্রতিরক্ষা বাজেটের কোনো তথ্যই মোটামুটি থাকে না। কেবল ছোট একটি অনুচ্ছেদ থাকেকিন্তু প্রতিরক্ষা বাজেট নিয়ে জনগণের জানার অধিকার আছে। আরেকটি বিষয়বাজেটের আয়ব্যয় নিয়ে বলা হয়। কিন্তু বাজেট বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াকে অংশীদারমূলক করা সম্ভব। এজন্য উন্মুক্ততা জরুরি। তিন মাস পরপর বাজেট বাস্তবায়ন অগ্রগতি জনগণকে জানানো যেতে পারে। মোটামুটি এ তিন বিষয়ের ওপর আমাদের বিশেষ আগ্রহ।
 
আলোকিত বাংলাদেশ আপনাকে ধন্যবাদ।
ইফতেখারুজ্জামান আপনাদেরও ধন্যবাদ।
 
ইফতেখারুজ্জামাননির্বাহী পরিচালকট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)
 
লিখাটি ১৭-০৬-১৪ তারিখে আলোকিত বাংলাদেশ পত্রিকায় প্রকাশিত।
লিঙ্ক