দুদক কি প্রভাবমুক্ত হতে পেরেছে?

প্রকাশকাল: ২০ ডিসেম্বর ২০১২

পদ্মা সেতু

দুদক কি প্রভাবমুক্ত হতে পেরেছে?

ইফতেখারুজ্জামান

পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হওয়া জটিলতার মুখে বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ দলের পর্যবেক্ষণে দুদকের তদন্তের ফলাফলের দিকে সবাই তাকিয়ে ছিল। ভাবা হয়েছিল, একটি সুষ্ঠু তদন্ত প্রতিবেদনের মাধ্যমে জটিলতার অবসান হবে, পদ্মা সেতু প্রকল্প হিমাগার থেকে বেরিয়ে সচল হতে শুরু করবে। একই সঙ্গে দুদক তো বটেই, স্বয়ং সরকারের জন্যও একটি সম্মানজনক অবস্থানে পৌঁছার সুযোগ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু দুদকের নিজস্ব অনুসন্ধান দলের প্রতিবেদনের পরিপূর্ণ গুরুত্ব না দিয়ে প্রতিষ্ঠানটির প্রশ্নবিদ্ধ সিদ্ধান্ত এবং দুজন মন্ত্রীকে অভিযোগ থেকে রেহাই দিয়ে মামলা করার মাধ্যমে সেই সুযোগটি তারা হারাতে বসেছে বলে মনে করি। একই সঙ্গে দেশবাসীর বহু প্রতীক্ষিত পদ্মা সেতুর ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার অন্ধকারেই রয়ে গেল। এ পর্যায়ে বিশ্বব্যাংক ও অন্য দাতা সংস্থাগুলো যদি আবার এই বিতর্কিত প্রকল্পে ফিরে আসে, তাহলে অবাক হব।

বিশ্বব্যাংক তাদের সর্বশেষ প্রত্যাশা হিসেবে পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে একটি পরিপূর্ণ ও সুষ্ঠু তদন্ত দেখতে চায় বলে জানিয়েছিল। সেটি তারা কতটা পেল, তারাই সেটার বিচার করবে। পরিপূর্ণতার কথা বললে বলা যায়, দুদকের নিজস্ব প্রতিবেদন অনুযায়ী যাঁদের বিরুদ্ধে দুর্নীতিতে সম্পৃক্ততার অভিযোগ এনে তালিকা তৈরি করা হয়েছে, সেই তালিকার সবাইকে এক মাপকাঠিতে দেখা হলো কি না, তা বিশ্বব্যাংক বিবেচনা করবে। বিশেষ করে দুজন মন্ত্রীকে মামলার অভিযুক্তের তালিকা থেকে বাদ দেওয়ায় মাপকাঠি নিয়ে প্রশ্নটা উঠবেই। তার পরও অর্থমন্ত্রী আশা করেছেন, বিশ্বব্যাংক প্রকল্পে ফিরে আসবে। তারা ফিরে আসুক, এটা সবাই চায়।

বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ দলের সঙ্গে আলোচনা করেই দুদক এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে বলে জানানো হয়েছে। তাই যদি হয়, তাহলে বিশ্বব্যাংকেরও কিন্তু একদিক থেকে দুর্নীতির অভিযোগে কার বিরুদ্ধে মামলা হবে, তা জানার কথা। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক পুরো প্রক্রিয়ায় বিশ্বব্যাংকের হস্তক্ষেপের বিষয়েও। সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠবে, বিশ্বব্যাংক কেন চুক্তি বাতিল করল এবং দেশবাসীকে অসম্মানজনক অবস্থায় নিয়ে গেল। তা সত্ত্বেও আমরা চাই, বিশ্বব্যাংক ফিরে আসুক।

তবে এর ফলটা যা-ই হোক না কেন এবং সরকারের বর্তমান মেয়াদে পদ্মা সেতুর কাজ শুরু হোক বা না হোক, আমরা দেখতে পেলাম, একটি যথাযথ, নির্ভরযোগ্য ও নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে দুদক তার হারানো ভাবমূর্তি ফিরে পাওয়ার বড় ধরনের সুযোগ থেকেও নিজেদের বঞ্চিত করল। দুদক নিয়ে জনমনে যে আস্থার ঘাটতি রয়েছে, তাকে কাটিয়ে ওঠার যে সম্ভাবনা ছিল, তাকে গুরুত্ব দিয়ে যদি তারা দুর্নীতির অভিযোগপত্র তৈরি করত, তাহলে আজ এভাবে প্রশ্ন উঠত না। গণমাধ্যমে প্রকাশিত দুদক সূত্রেই জানতে পারি, দুদকের অনুসন্ধান টিম দুর্নীতির অনুসন্ধানে যে রকম পেশাদারির প্রতিফলন ঘটিয়েছে, প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ-প্রক্রিয়ায় সে রকম পেশাদারি, দৃঢ়তা ও প্রভাবমুক্ত হয়ে কারও প্রতি করুণা বা ভয়ের ঊর্ধ্বে থেকে অগ্রসর হওয়ার সৎ সাহসের প্রতিফলন ঘটানো বাঞ্ছনীয় ছিল। এ ক্ষেত্রে দুদকের হারানোর কিছু ছিল না, ছিল অনেক পাওয়ার। সেই সুযোগটি নিতে না পারায় দুদকের স্বাধীনভাবে ও সাহসের সঙ্গে কাজ করা সম্পর্কে যে আস্থার ঘাটতি জনমনে ও আন্তর্জাতিকভাবে হয়েছে, সেটা দূর না হয়ে বরং আরও জোরদার হয়েছে। এ কারণেই বলছি যে তারা ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে ব্যর্থ হয়েছে। সেতুর ভবিষ্যৎ আবারও অনিশ্চিত এবং প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে। তবে হয়তো এখনো সুযোগ আছে।

বিশেষ করে মামলার তালিকায় দুই সাবেক মন্ত্রীকে বাদ দেওয়ার বিষয়টি দুদকের সর্বশেষ বক্তব্যে যেভাবে এসেছে, সেটি কতটুকু যথার্থ, তা পরিষ্কার নয়। এর জন্য তারা মন্ত্রীর অমনোযোগিতার দোহাই দিয়েছে। বাস্তবে মন্ত্রী অমনোযোগী ছিলেন, নাকি পুরো প্রক্রিয়ায় অতিমনোযোগী ও অতিকৌশলী ছিলেন, সেই প্রশ্নও আসবে। বাংলাদেশের মতো দেশে মন্ত্রীদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অংশগ্রহণ ছাড়া এ ধরনের একটি বিরাট প্রকল্পে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর্যায়ে দুর্নীতির ক্ষেত্র তৈরি করা সম্ভব নয়। চারবার কমিটি পুনর্গঠন থেকে শুরু করে পুরো প্রক্রিয়ায় যে স্বচ্ছতার ঘাটতি প্রতীয়মান হয়েছে, এবং তার মাধ্যমে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে, সেগুলো মন্ত্রীর অংশগ্রহণ ছাড়া কতটা সম্ভব? এ ব্যাপারে অমনোযোগিতার দোহাই জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। বিশেষ করে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জ্ঞাতসারে যখন মন্ত্রী এসএনসি-লাভালিনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে একাধিক বৈঠকে মিলিত হন। অন্যদিকে উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কমিটিতে অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীসহ আরও দুজন স্বনামধন্য ব্যক্তির অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারে সেতু বিভাগের সচিব এককভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন কি না, সেটাও ভেবে দেখা দরকার।

সাবেক মন্ত্রী বা অন্য যেকোনো সন্দেহভাজন বা অভিযুক্ত ব্যক্তিকে বিচার-প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রমাণিত হওয়ার আগে বাস্তবে দুর্নীতিগ্রস্ত বা অপরাধী যেমন বলা যাবে না, তেমনি সন্দেহভাজন তালিকাভুক্ত করার নামে তাঁদের নির্দোষ বলে দায়মুক্তির প্রচ্ছন্ন প্রয়াসও গ্রহণযোগ্য হবে না। এভাবে দুদক কর্তৃক এরূপ অব্যাহতির সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া বাস্তবে দুদকের নিজেরই বিচারিক ভূমিকা পালনের শামিল হয়ে দাঁড়ায়। দুজনকে তালিকার বাইরে রেখে বাস্তবে বিচারকের কাজটা দুদকই করে ফেলল। তাঁরা যদি নির্দোষই হন, তাহলে সেটা আদালতে প্রমাণিত হতে অসুবিধা কোথায়?

কোনো রকম প্রভাবমুক্ত হয়ে বা কারও প্রতি ভয় বা করুণা না করে দুদক যদি পেশাদারির সঙ্গে তদন্ত কাজ পরিচালনা করে এবং সন্দেহভাজন তালিকাভুক্তদের ক্ষেত্রে প্রমাণ সাপেক্ষে শক্ত অবস্থান নিতে পারে, তাহলে হয়তো দুদকের ভাবমূর্তি রক্ষিত হবে এবং আস্থাহীনতাও কাটিয়ে উঠতে পারবে।

নির্বাচনের এক বছরের কম সময় বাকি। জনগণ এখন নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলোর খতিয়ান করবে। এ পরিপ্রেক্ষিতে অবশ্যই আরেকটা জিনিস বিশেষ করে সরকারের অনুধাবন করা দরকার, বিশ্বব্যাংকসহ অন্য তিনটি সাহায্য সংস্থার সহায়তায় অথবা অন্য যেকোনোভাবে পদ্মা সেতুর ভাগ্য নির্ধারিত হোক বা না হোক, সার্বিক বিবেচনায় এই প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগকে কেন্দ্র করে গত প্রায় দুই বছরে সরকারের ভূমিকা নির্বাচনী অঙ্গীকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতার সঙ্গে কতটুকু সামঞ্জস্যপূর্ণ? এই প্রশ্নের উত্তর জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যভাবে পৌঁছাতে সরকারকে যথেষ্ট বেগ পেতে হবে।

ইফতেখারুজ্জামান: নির্বাহী পরিচালক, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।

লিখাটি ২০ ডিসেম্বর, ২০১২ দৈনিক তে প্রকাশিত হয়েছে

লিঙ্ক